২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার

বাবুগঞ্জে গভীর রাতে জোড়া খুনঃ ডাকাতি বলে সাজানোর চেষ্টা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:৩১ অপরাহ্ণ, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩

বাবুগঞ্জে গভীর রাতে জোড়া খুনঃ ডাকাতি বলে সাজানোর চেষ্টা

আরিফ আহমেদ মুন্না বরিশালের বাবুগঞ্জে গভীর রাতে বসতঘরে খুন করা হয়েছে এক গৃহবধূ ও তার দাদিশাশুড়িকে। পরিকল্পিত এই খুনের ঘটনাকে ডাকাতি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় বাড়ির পেছনে কাটা হয়েছে সিঁধ। এ ঘটনায় সন্দিগ্ধ স্বামীকে আটক করেছে পুলিশ। রাতের খাবারের সাথে বিষ প্রয়োগে কিংবা শ্বাসরোধ করে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। বুধবার মধ্যরাতে বাবুগঞ্জ উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন খন্দকার বাড়ির প্রয়াত ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন খন্দকার ওরফে দেলোয়ার মেম্বারের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।

হত্যাকাণ্ডের শিকার দুই নারী হলেন ভূতেরদিয়া গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের স্ত্রী লালমুন্নেছা বেগম (১০০) এবং সোলায়মান হোসেনের স্ত্রী গৃহবধূ নাজমুন নাহার রিপা (২৩)। নিহতরা সম্পর্কে দেলোয়ার মেম্বারের মা এবং পুত্রবধূ। এসময় অচেতন হয়ে পড়া দেলোয়ার মেম্বারের স্ত্রী মিনারা বেগমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে হাসপাতালে তার জ্ঞান ফিরলেও তিনি রহস্যজনক আচরণ করছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। ওই ঘরে ৩ নারী ছাড়া আর কেউ থাকতেন না। ঘরের একমাত্র পুরুষ সোলায়মান হোসেন খন্দকার (৩০) ব্যবসার অজুহাতে থাকতেন বরিশালের কাশিপুর আবহাওয়া অফিস সংলগ্ন বোনের বাড়িতে। দাম্পত্য কলহের জের ধরেই পরিকল্পিতভাবে এই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছে নিহত গৃহবধূ নাজমুন নাহার রিপার পরিবার। অভিন্ন ধারণা পুলিশেরও।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতের প্রতিবেশি মরিয়ম বেগম জানান, বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার একই বাড়ির দেলোয়ার মেম্বারের ঘরের সামনে অজ্ঞাত এক ব্যক্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেন। তবে অস্পষ্ট আলোতে তিনি তাকে সনাক্ত করতে পারেননি। এসময় সন্দেহ হলে তিনি দেলোয়ার মেম্বারের ঘরে গিয়ে দেখতে পান ঘরের সিঁধ কাটা ও দরজা খোলা এবং ঘরে থাকা ৩ নারীই অচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে রয়েছেন। এসময় তিনি ডাক-চিৎকার দিলে বাড়ির লোকজন বের হয়।

পরে তাদের ৩ জনকেই বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক লালমুনন্নেছা বেগম এবং নাজমুন নাহার রিপাকে মৃত ঘোষণা করেন। এসময় মিনারা বেগমকে অচেতন অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি করা হয়। এদিকে বৃহস্পতিবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মিনারা বেগমের (৫০) জ্ঞান ফিরলেও তিনি মুখ না খোলায় রহস্যের জট সম্পূর্ণ খুলছে না। থানায় আটক দেলোয়ার মেম্বারের ছেলে অভিযুক্ত সোলায়মান হোসেন খন্দকারকে (৩০) পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার দায় স্বীকার করেননি।

নিহত গৃহবধূ নাজমুন নাহার রিপার মা ইয়াসমিন বেগম অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রথম বিয়ের কথা গোপন করে প্রায় ৩ বছর আগে রিপাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করে সোলায়মান। তখন রিপা সরকারি বিএম কলেজে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল। বিয়ের পরে রিপার পড়াশোনাও বন্ধ করে দেয় সোলায়মান।তার আগের বিয়ের খবর ফাঁস হওয়ার পর থেকেই রিপাকে শারিরীক আর মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করে স্বামী সোলায়মান ও তার মা মিনারা বেগম এবং বোন মুক্তা আক্তার। দেড়বছর আগে রিপাকে মারপিট করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে ডাকে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছিল সোলায়মান। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সালিশ-মীমাংসার মাধ্যমে ২ লাখ টাকা নতুন কাবিন করে আবার রিপাকে ঘরে তুলে নেয় সোলায়মান।’

রিপার মা ইয়াসমিন বেগম আরও জানান, প্রথম বিয়ের কাবিন ছিল ৫০ হাজার টাকা। এরপরে দ্বিতীয়বার কাবিন করে আবার বিয়ে করার পরে রিপাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে ফেলে রেখে বরিশাল কাশিপুর এলাকায় বোন মুক্তার বেগমের বাড়িতে গিয়ে ওঠে সোলায়মান। রাইস মিলের ব্যবসার অজুহাতে সোলায়মান সেখানেই বসবাস শুরু করে। মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে থেকেও এক-দেড় মাস পরপর বাড়িতে আসতো সে। দীর্ঘদিন পরে বাড়িতে এসেও রিপাকে অকারণে বেধড়ক মারপিট করতো। বাড়িতে সোলায়মানের মা নির্যাতন করতো। তবে দাদিশাশুড়ি লালমুন্নেছা রিপাকে অনেক ভালোবাসতেন। মা এবং বোন মুক্তার সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে রিপাকে হত্যা করেছে সোলায়মান। এছাড়াও তার দাদিশাশুড়ি রিপাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো বলে সাক্ষী সরিয়ে দিতে নিজের দাদিকেও খুন করেছে পাষণ্ড সোলায়মান বলে অভিযোগ করেন ইয়াসমিন বেগম।

বাবুগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড যা ডাকাতি বলে চালিয়ে দিয়ে ডাকাতের ঘাড়ে খুনের দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ডাকাতি প্রমাণ করার জন্য ঘরের পেছনে সিঁধ কাটা হয়েছিল। তবে সেই সিঁধের ছিদ্র থেকে কোনো ৫ বছরের বাচ্চা ঢোকাও অসম্ভব। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে ঘাতক ঘরেই ছিল এবং কাজ সেরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে। ঘটনার মূল সন্দিগ্ধ সোলায়মানকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। হাসপাতালে ভর্তি থাকা সোলায়মানে মা মিনারা বেগম রহস্যজনক আচরণ করছেন। তিনি এখনো মুখ খোলেননি। পুলিশ দেখলেই অসুস্থ হয়ে আবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। নিহতদের পোস্টমর্টেমের জন্য শেবাচিম হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলেই কী দিয়ে বা কীভাবে তাদের হত্যা করা তা স্পষ্ট হবে।’

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ ফরহাদ সরদার বলেন, ‘পারিবারিক কলহের জের ধরে রাতের খাবারের সাথে চেতনানাশক বা বিষ প্রয়োগ করে কিংবা বালিশচাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে দুইজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি আমরা। তবে ভিকটিমদের পোস্টমর্টেম এবং ফরেনসিক রিপোর্ট পেলে নিশ্চিত করে বলা যাবে। প্রাথমিক তদন্তে সন্দিগ্ধ এবং নিহত গৃহবধূর পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে তার স্বামী সোলায়মান হোসেন খন্দকারকে (৩০) আটক করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তার মা মিনারা বেগম ঘটনার মূল প্রত্যক্ষদর্শী বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার জবানবন্দি না পেলে রহস্যের সম্পূর্ণ জট খুলবে না।’

বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সুবাস সরকার জানান, বুধবার মধ্যরাতে দুজন মৃত এবং একজন অসুস্থ নারীকে নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন কিছু লোক। দুজনকে আমরা মৃত হিসেবে সনাক্ত করি এবং মিনারা বেগম নামে অপর একজনকে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি করি। তবে তিনি বর্তমানে সুস্থ এবং শঙ্কামুক্ত রয়েছেন। তার শরীরে বাহ্যিকভাবে কোনো আঘাতের চিহ্ন কিংবা বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে কেমিক্যাল টেস্ট করা হলে বিস্তারিত জানা যাবে।

এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘটনার মূল সন্দিগ্ধ আসামী হিসেবে আটক সোলায়মান হোসেন খন্দকারকে বাবুগঞ্জ থানায় জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। তখন পর্যন্ত তিনি হত্যার দায় স্বীকার করেননি। নিহত গৃহবধূ নাজমুন নাহার রিপার বাবা চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন। খবর পেয়ে তিনি সন্ধ্যায় বাড়িতে এসেছেন এবং হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছে নিহতের পরিবার।’

6 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন