২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

‘বায়না পেতে শুরু করলাম বন্ধুদের প্রেমপত্র লেখার’

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৭:০৭ অপরাহ্ণ, ২৩ অক্টোবর ২০১৮

কলেজে উঠেই মায়ের কড়া শাসন এড়াতে উঠলাম ডিকেবি হোস্টেলে। বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গির ভাই তার ১০২ নম্বর রুম বরাদ্দ দিলেন আমাদের। আমি, তুষখালীর হায়দার আর সাতক্ষিরার মোহসিন থাকতে শুরু করালাম স্বাধীন এই কক্ষটায়। ক’দিনের মধ্যেই হোস্টেল জমে গেলো। আমার হাতেরলেখা ছিলো সুন্দর। বায়না পেতে শুরু করলাম হোস্টেল বন্ধুদের প্রেম পত্র লেখার। আমি রুমে এলেই ভিড় শুরু হতো প্রেমিকদের।

 

এতে মারাত্মক বিরক্ত হতো হায়দার ও মোহসিন। এটি কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না দেখে ওরা দুজন মিলে প্রেমপত্র লেখাটাকে বানিজ্যিক রুপ দেয়ার সিদ্দ্বান্ত নিলো। দুজনের তখন স্টার সিগারেট ফূকতো। ডাইনিং এ বসে ঘোষনা হলো এখন থেকে যে আমার কাছে চিঠি লেখাতে যাবে তাকে ফি দিতে হবে। প্রেমিকাকে পটিয়ে চিঠি লেখার ফি ২ শলা স্টার সিগারেট অথবা নগদ আট আনা। যাবতীয় মিথ্যা অর্থাৎ ভুয়া জ্বর, ভুয়া অসুস্থ্যতা জাতীয় চিঠির জন্য ৪ শলা, ঝগড়ার কঠিন জবাব ৫ শলা, ঝগড়ার পর আপোষ মার্কা চিঠি ৫ শলা সিগারেট। প্রথম প্রেমের প্রথম চিঠি ফ্রি। দ্বিতীয় প্রেমের প্রথম চিঠির জন্য এক প্যাকেট স্টার ইত্যাদি। ওরা ভেবেছিলো ভ্যাট বসালে ভীড় কমবে। দেখা গেলো উলটো চিত্র। ভীড় আরো বাড়তে লাগলো।

 

হঠাৎ একদিন দুলাল নামের আমাদের এক বন্ধু এসে বললো তাকে একটা পটানো মার্কা চিঠি লিখে দিতে হবে এবং এটা মেয়ের হাতে পৌছেও দিতে হবে। দরদাম ঠিক হলো তিনটা সিনেমার টিকেটের দাম সাড়ে ৪টাকা আর সাথে ঝুকি ভাতা হিসেবে ৫০ পয়শা ও এক প্যাকেট স্টার আগাম দিতে হবে। দুলাল রাজি হলো। নাম ঠিকানা জানা হলো, মেয়েটি বৃহস্পতিবার বিটিভির নাটক দেখে বারান্দায় শুকানো কাপড়গুলো ঘরে তুলতে বের হলে তাকে চিঠিটা চালান করতে হবে। মেয়েটির সাথে দুলালের হাবভাব আছে এবং সে জানে যে আমরা তিনজন একটা কিছু নিয়ে ঐ সময়টায় যাবো। ভাইরে তিনজন মিলে সিনেমার টাকায় হোটেলে মোগলাই পরাটা খেয়ে সময়মত হাজির হলাম। তখন এতো বিদ্যুৎ ছিলো না। দূরে লাইটপোস্টে ৬০ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছিলো। হায়দার প্রথমেই ইট মেরে বাল্বটির জীবনাবসান ঘটালো। ভালোই শীত পড়েছিলো সেই রাতে। আমরাও গিয়ে বাসার সামনে হাজির আর দোচালার দরজাদিয়েও কেউ একজন বের হলো।

 

আর পায় কে, মোটামোটি বড় একটা ইট চিটির মধ্যে মুড়িয়ে হায়দায় স্বজোরে ছুড়ে দিতেই চিৎকার শুরু হলো, ‘ওরে বাবারে, মরে গেলাম রে, আমারে মাইররা ফালাইলো রে’।

 

অবস্থা বেগতিক দেখে দৌড়ানোয় সময় আমরা দেখলাম ইট পড়েছে মেয়েটির মায়ের কপালে আর চিঠি উড়ে আসছে জবা ফুলের গাছের দিকে। দিশেহারা হয়ে বাম কোনা দিয়ে পালাতে গিয়ে তিনজনই পড়লাম ময়লা ডোবায়। এদিকে লোকজনও বের হতে শুরু করলো। শীত বলে দ্রুত মানুষ বের হয়নি তাই এ যাত্রায় রক্ষে। সেই সুযোগে ডোবা আর কচুরিপানা ডিঙ্গিয়ে হাজির হলাম হোস্টেলার ঘাটলায়। লক্ষির মাকে দিয়ে রুম থেকে লুংগি আনিয়ে জামা কাপড় সব ঘাটলায় রেখে লক্ষির মায়ের হাতে একটাকা গুজে দিলাম ওগুলো ধোয়ার জন। শীতে তখন আমরা থরথর। রুমে গিয়ে দেখি দুলাল ফেটে পড়ছে। সে সব খবর পেয়ে গেছে।

 

বললাম দুলাল, ভাইরে, সব আশা সবার পুরোন হয়না। তুই আল্লা আল্লা কর, যাতে ইটের আঘাতে কেউ মরে না যায়, তাইলে কিন্তু খবর আছে’। একথা বলে শেষ করতে পারিনি এর মধ্যে দুলাল ঝাপিয়ে পড়লো আমাদের উপর। বললো তার সব টাকা এক্ষুনি ফেরত দিতে হবে এখন এই মূহুর্তে। আমাদের জন্য নাকি ওর জীবনটা মাটি হয়ে গেলো ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে মোহসীন আমাকে স্মরন করিয়ে দিলো যে চিঠিতে হাতের লেখা আমার, কেউ চিঠি হাতে পেলে খবর আছে। কি আর করবো, কাপড় বদলে লেটেস্ট খবর জানতে আবার ঐ ঘরমুখো হলাম।

 

গিয়ে দেখি তখনও লোকজন আছে। ভদ্র ছেলের মতো ভান করে কি হয়েছে বলে ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম কাপড়ের মধ্যে গরম ভাত ভরে মহিলার কপালের ফুলা জখমের স্থানটিতে ভাপ দেয়া হচ্ছে। এদের কাছে গল্প যা শুনলাম তা হলো ‘তিনজন চোর চালে উঠেছিলো, ওরা ডাকাতও হতে পারে। ওদের হাতে রাম দাওয়ের মতো কি যেনো ছিলো। আজ ঐ ঘরের কিছুই থাকতো না, ডাকাতরা সব লুট করার পরিকল্পনা করেই এসেছিলো। ভাগ্যিস বাড়ির কতৃ নিজেই কাপড়গুলো ঘরে তুলতে বের হয়েছিলেন। লোকগুলো তাকে চিনিতে পেরে ইট মারতে শুরু করে, তার ডাকচিৎকারেই পালিয়ে যায়”। ভয়াবহ এমন গল্প শুনে আমি যখন ‘থ’ মেরে আছি তখন মনে হলো কেউ আমাকে কুনুই দিয়ে গুতো দিচ্ছে। পেছনে তাকাতেই দেখি হাসিমুখে হায়দার, বাইরে ডাকছে।

 

ওর ইশারায় বাইরে আসার আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বললাম,’কোন চিন্তা নেই, আমরা আছি। দরকার হলে রাতে আবার আসবো, আমরা ঐ হোস্টেলেই থাকি, ইত্যাদি ইত্যাদি’। বাইরে আসার সময় দেখি বারান্দার দরজায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রাগে ফোস ফোস করছে। আমাদের দেখে মুখ ভেংচি মেরে সরে গেলো। রাস্তায় বের হতেই দেখি দুলাল কাদছে। বললাম ‘তোর আবার কি হলো’। দুলাল ডাস্টবিনের চেয়েও নোংরা ভাষায় গালী দিয়ে বলোলো,’ দ্যাহো নাই কি হইছে, যে মাইয়াডা তোগো ভেংচি দিয়া আমার ১২ডা বাজাইয়া ঘরের মইধ্যে গেছেইগ্যা, হেইডাই ঐ মাইয়া’।

 

অতিরিক্ত গালি খাবার ভয়ে দুলালের কথা উত্তর না দিয়ে হায়দারকে বললাম, ‘তোর কি হইছিলো, তুই গুতা দিলি ক্যা, হাসলিওবা ক্যা’। হায়দার পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো,’আমরা এখন ঝুকিমুক্ত’। বললাম এটা পেলি কোথায়। ও বললো আমি যখন কথা বলছিলাম তখন হায়দার বাইরে চিঠির সন্ধান করতে গিয়ে জবাফুল গাছে এটি পেয়েছে। দুলাল এক ঝাপটায় চিঠিটা ওর হাতে নিয়ে বলেছিলো,’ ক্যাশ টাকায় চিঠি লেহাইছি, এইডা আমার সম্পত্তি’।

ছাত্র জীবনের অনেক দুস্টুমির একটা ছিলো এই ঘটনা। লিখলাম এজন্য যে আজ লক্ষ্মির হাটে স্ত্রিসহ দুলালের সাথে দেখা হয়েছিলো। ওর স্ত্রির সাথে পরিচয় হবার আগ থেকেই মহিলাটি খুব হাসছিলো। বললাম, কি হয়েছে’। দুলাল বললো ও তোরে চেনে। হায়দার আর মোহসিন কোথায় থাকে জানিনা, ওদের নামও ও জানে। আমি বললাম, মানে’। দুলাল বললো ‘এই সেই মেয়ে’, এখন আমার দু সন্তানের জননী।

মুরাদ আহমেদ,সাংবাদিক ও বাচিক শিল্পী
8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন