২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

বরিশাল বিএনপিতে স্বস্তির আবহ, ত্যাগি-বঞ্চিতদের সমন্বয়ে কমিটি নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:১২ পূর্বাহ্ণ, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বরিশাল বিএনপিতে স্বস্তির আবহ, ত্যাগি-বঞ্চিতদের সমন্বয়ে কমিটি নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল:: স্থানীয় রাজনীতিতে বিগত দিনের বিরোধ এবং নিজেদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটানোসহ রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম চাঙা করতে কৌশলী পথে হাঁটতে শুরু করেছে বরিশাল বিএনপি। আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে হামলা-মামলা এবং তৎসময়ে কমিটিতে পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের এবার গুরুত্ব দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করার একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ বছরের মার্চে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে এবং রাজপথে শক্তি জানান দেওয়ার বিষয়টি মনেপুষে স্থানীয় রাজনীতির বিভাজন মেটাতে এমন উদ্যোগ নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে বরিশাল জেলার নেতারা। মাঠপর্যায়ে কে কোন নেতার অনুসারী সেই বিষয়টি আপাতত ভুলে গিয়ে আগামী দিনগুলোতে একট্টা হয়ে কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচি পালন এবং আন্দোলন বেগবান করতে রাজনৈতিক সমাঝোতা অর্থাৎ এককাতারে নিয়ে আসতে বিগতসময়ে ঘোষিত পকেট কমিটিগুলো বিলুপ্ত করতে উদ্যোগগ্রহণ করেছে। সেই সাথে পদবঞ্চিত ত্যাগি নেতাদের সমন্বয়ে সর্বাপোরি গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠনে পদক্ষেপ নিয়েছে। সোমবার বরিশাল সদর উপজেলার কমিটি বিলুপ্ত এবং এই কমিটির বিরোধীতা আসা পদবঞ্চিত নেতাদের একত্রিত করে নতুন কমিটি ঘোষণা দিয়ে জেলা (দক্ষিণ) বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক এমপি আবুল হোসেন ও সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম শাহীন বেশ আলোচনায় এসেছেন। এবং আগামীতে উপজেলাগুলোর কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও চমক থাকছে বলে বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্রটি জানায়, কয়েক ভাগে বিভক্ত বরিশাল বিএনপি যে পথ-গতি দুটোই হারিয়েছে তা গত ৪ ফেব্রুয়ারি শহরের জিলা স্কুল মাঠে আয়োজিত সমাবেশে হাইকমান্ড আঁচ করতে পেরেছে। ওই সমাবেশে নেতাকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও অশৃঙ্খল পরিবেশ এবং সবাই নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতার বিষয়টি শীর্ষ নেতারা ইতিবাচক হিসেবে নেননি। তবে এনিয়ে প্রকাশ্যে হাইকমান্ড কিছু না বললেও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ওপর যে নাখোশ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে সমাবেশে শেষে কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকায় ফেরার পূর্বে স্থানীয় বিএনপির নেতৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকা এবং রাজপথে আগামীদিনগুলো শক্তপোক্ত ভূমিকা রাখার তাগিদ দেন। সেই নির্দেশনার আলোকেই বিতর্কিত কমিটি ভেঙে বা বিলুপ্ত করে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে গ্রহণযোগ্য কমিটি করার উদ্যোগ নেন। যার প্রাকপ্রস্তুতিস্বরুপ বরিশাল সদর উপজেলায় নুরুল আমিন (সভাপতি) এবং রফিকুল ইসলাম (সদস্যসচিব) সেলিমের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে নতুন ঘোষিত কমিটিতে ত্যাগি-বঞ্চিত নেতাদের নিয়ে আসা হয়েছে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সভাপতি মজিবর রহমান নান্টু এবং সদস্যসচিব আকতার হোসেন মেবুলের রাজনৈতিক অদূরদর্শী হওয়া সত্বেও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার লক্ষে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি-বিশেষকে কমিটিতে স্থান দিয়ে বেশ সমালোচনার সৃষ্টি করেন। বিশেষ করে স্থানীয় রাজনীতিতে নিজেদের আধিপত্য বৃদ্ধিতে তারা এই কৌশল নেন এবং একসময়ের রাজনৈতিক গুরু মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ারকে কর্মীশূন্য করে কোণঠাসা করে রাখেন। ফলে সরোয়ার একা হয়ে যান এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে অভাবে স্থানীয় বিএনপির রাজনীতি ক্রমশই সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এবং দলের অভ্যন্তরে চলে নিরব বিদ্রোহ, পরবর্তী সময়ে তুষের আগুনের ন্যায় জ্বলতে থাকে।

অবশ্য এর কারণে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সরোয়ারকেও দোষারোপ করা হয়, তিনি এক এক সময়ে এক এক নেতাকে সমর্থন দেওয়ায় বিভাজিত বরিশাল বিএনপিতে গ্রুপিং জোরালো রুপ নেয়। যদিও এখানকার বিএনপি নেতারা এই মুহূর্তে বলছেন, নেতা সরোয়ার তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমে এখন আর হস্তক্ষেপ করছেন না, তাঁর কর্মী-সমর্থক নিয়ে এক কূলে অবস্থান নিয়ে আছেন। তবে তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে ফের প্রভাববিস্তারের মানসিকতা নিয়ে বহুমুখী কৌশল অবলম্বন করছেন, যার অংশ হিসেবে অনুগতদের যে কোনো মূল্যে নতুন কমিটিতে স্থান করে দিতে চাইছেন। বিষয়টি নিয়ে সরোয়ার মুখ না খুললেও তাঁর সান্নিধ্যে থাকা কয়েকজন বিএনপি ও ছাত্রদল নেতা এমন ধারণা দিয়েছেন।

সূত্রগুলো জানায়, শুধু নেতা সরোয়ার নন, নেতৃত্বে বিভাজন এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধে তৎসময়ের প্রতাপশালী নেতা এবায়দুল হক চাঁদ, অ্যাডভোকেট বিলকিছ জাহান শিরিন এবং মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক ও সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে গিয়ে দলের ভেতরে তৈরি করেন একাধিক উপদল। যার দরুণ আন্দোলন-সংগ্রামে বিভক্ত বিএনপি রাজপথে শক্তপোক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। সম্প্রতি সেই বিভাজন এতটা প্রকট রুপ নেয় যে ৪ ফেব্রুয়ারি জিলা স্কুল মাঠে কর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণ নিয়ে নেতৃবৃন্দকে ঘোর টেনশনে ফেলে দেয়। একটা পর্যায়ে কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতি সেই টেনশন কিছুটা দূর করলেও স্থানীয় রাজনীতিতে বিভক্তি ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিএনপির একজন অন্যতম সদস্য জানান, কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন এবং আগামীতে আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার করার ভাবনায় জেলা দক্ষিণের আহ্বায়ক আবুল হোসেন ও সদস্যসচিব আবুল কালাম শাহীন উপজেলাপর্যায়ের বিতর্কিত কমিটিগুলো ভেঙে বা বিলুপ্ত করে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। সেক্ষেত্রে কে কার অনুগত বা অনুসারী এই বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে ত্যাগি ও বিগত সময়ে দলে উপেক্ষিতদের গুরুত্ব দিচ্ছেন। অবশ্য এমনটি পরিচ্ছন্ন মানসিকতার পরিচয় এবং দলের জন্য ইতিবাচক বলে মন্তব্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে তাদের এই কৌশলী পদক্ষেপ বিএনপির তৃণমূলে বেশ প্রসংশিত হচ্ছে।

অভিন্ন মন্তব্য করে একাধিক তৃণমূল নেতাকর্মী জানান, আগামীতে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতে নিজেদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ ভুলে গিয়ে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসবে হবে। এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটিগুলোতে পদবঞ্চিত ত্যাগি নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন পরবর্তীতে নেতৃত্ব সারিতে নিয়ে আসাটাই হতে মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যেমনটি গ্রহণ করেছেন জেলার নেতারা।

বরিশাল সদর উপজেলার নয়া কমিটিতে স্থান পাওয়া এক নেতা জেলা (দক্ষিণ) বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন এবং আবুল কালাম শাহিনকে এমন দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার জন্য সাধুবাদ জানিয়েছেন। নামপ্রকাশ না করার শর্তে ওই নেতা জানান, সাবেক আহ্বয়ক মজিবর রহমান নান্টু এবং আকতার হোসেন মেবুল বিগত সময়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি ও বলয় সৃষ্টি আকাঙ্খায় নামসর্বস্ব ব্যক্তি-বিশেষকে কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করে ত্যাগিদের কোণঠাসা করে রাখেন। বিশেষ করে তাদের ঘোষিত বরিশাল সদর উপজেলার কমিটিতে এক সময়কার জামায়াত নেতা নুরুল আমিনকে সভাপতি এবং রফিকুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করলে তৃণমূলের বড় একটি অংশ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। এবং পদবঞ্চিতদের নেতা সদর উপজেলা চরবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জিয়াউল ইসলাম সাবুসহ কয়েকজনকে সাথে নিয়ে মাঠে নেমে কমিটি বাতিলের প্রতিবাদে নানান কর্মসূচি পালনসহ মিডিয়ার দ্বারস্থ হন ও হাইকমান্ডের সুদৃষ্টি কামনা করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এনিয়ে বড় অংশটি মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও তারা একটা পর্যায়ে নিশ্চুপ হয়ে যান এবং জেলা বিএনপির নতুন নেতৃত্বে অপেক্ষায় থাকেন।

কয়েক মাসের মাথায় নান্টু-মেবুলের কমিটি ভেঙে দিয়ে আবুল হোসেন-আবুল কালামের সমন্বয়ে জেলা (দক্ষিণ) বিএনপি নতুন কমিটি ঘোষণা করে হাইকমান্ড। মূলত এর পরেই তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ বড় ওই অংশটি আলো দেখতে পায় এবং বিতর্কিত কমিটি ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব রাখে। এরই মধ্যে ৪ ফেব্রুয়ারি সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ পরবর্তী দেওয়া নির্দেশনায় নড়েচড়ে বসেন জেলার শীর্ষ নেতা। এবং তারা সংকল্প নেন মার্চে সরকাবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে স্থানীয় বিএনপি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটানোসহ কে কোন নেতার অনুসারী সেটি না দেখে অবস্থান অনুযায়ী মূল্যায়নের।

অবশ্য এই নেতাদ্বয় কাজের বেলায় দেখিয়েছেনও এমনটি। প্রথম পদক্ষেপেই তারা সদর উপজেলার নুরুল আমিন ও রফিকের বিতর্কিত কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলে নিজেদের কারিশমা দেখিয়েছেন।

নতুন ঘোষিত কমিটিতে এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন বাচ্চুকে আহ্বায়ক এবং পূর্বের কমিটির সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম সেলিমকে একই পদে রাখলেও পদবঞ্চিত জিয়াউল ইসলাম সাবু, মন্টু খান, আব্দুল জব্বার, মাহাবুবুল আলম বাবুলকে যুগ্ম আহ্বায়কের মর্যাদা দিয়েছেন। এছাড়া পূর্বের বিতর্কিত কমিটির সভাপতি আহ্বায়ক নুরুল আমিনকেও অনুরুপ সম্মান দিয়ে কমিটির ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিব্যক্তি হচ্ছে- আবুল হোসেন এবং আবুল কালাম শাহিন পদবঞ্চিত ত্যাগি নেতাকর্মীদের যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তাতে নেতৃত্ব চাঙা হবে, কর্মী-সমর্থকরা প্রাণ ফিরে পাবেন। বিশেষ করে বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির যে দৈন্যদশা তা থেকে কিছুটা হলে পরিত্রাণ পাবে এবং তৃণমূলের বড় ওই অংশটিকে তাদের ভূমিকা উজ্জীবিত করবে।

এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অভিমত হচ্ছে- আবুল হোসেন এবং আবুল কালাম শাহীনের এই দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার বিরোধীতা না করে বরং তাদের সাথে থাকা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সহযোগিতা করা। যাতে করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে ঝাপিয়ে পড়তে পারে এবং বিএনপির এক সময়ের ঘাটি হিসেবে সমাধিক পরিচিত বরিশালের সাহস-শক্তি নিয়ে বিরোধী পক্ষকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।

এই প্রসঙ্গে আবুল হোসেন বা আবুল কালামের মন্তব্য না পাওয়া গেলেও তাদের ঘনিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিগত নেতৃত্বের মত আবুল হোসেন এবং আবুল কালাম নিজের শক্তি বৃদ্ধি নয়, তারা চাইছেন স্থানীয় বিএনপির নেতৃত্বকে ঢেলে সাজাতে। সেক্ষেত্রে কে কোন নেতার অনুসারী সেটিকে প্রাধান্য না দিয়ে দলে কার কতটুকু অবদান এবং বিগত সময়ে কী ভূমিকা রেখেছেন তার মূল্যায়নভিত্তিক মর্যাদা দিচ্ছেন। পাশাপাশি নতুন কমিটিগুলোতেও যোগ্যতা অনুসারে পদ দিচ্ছেন এবং দিবেন। এই বিশেষ পদক্ষেপ বা কৌশলের কারণে স্থানীয় রাজনীতিতে বিএনপি আর চাঙাভাব অনুধাবন করবে, নেতাদের কাছ থেকে মন্তব্য এসেছে।’

 

6 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন