২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

ভোলার চরগুলোতে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:১০ অপরাহ্ণ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ভোলার চরগুলোতে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা

জিয়াউল হক, ভোলা থেকে ফিরে:: ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য চরাঞ্চল। এখানে রয়েছে পর্যটন শিল্প বিকাশের অপার সম্ভাবনা। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে ইতোমধ্যে চরফ্যাশন উপজেলা পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ভোলা জেলার এসব দ্বীপগুলো ভ্রমণের সেরা সময় হয় শীতকাল। এ সময় মনপুরা, চর কুকরি মুকরির আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আবার ক্যাম্পিং করার জন্যও শীতকালই সেরা। কারণ বর্ষায় চরের বেশিরভাগই ডুবন্ত থাকে। এ কারণে শীত বাদে অন্যান্য সময় চর কুকরি মুকরি ভ্রমণে না যাওয়াই ভালো। চর কুকরি মুকরি ভ্রমণের আদর্শ সময় হলো জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস।

বাংলার মোহনীয় দ্বীপ ভোলা, বিস্তৃর্ন জলরাশি, বালুকাময় সৈকত, যতদুর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ আর সবুজ, তারই সাথে হাতছানি দিতে থাকে টুকরো টুকরো নিবিড় বনভূমি, এছাড়া ও পাখির কল কাকলি এবং হরিনসহ বিভিন্ন বিরল প্রানীর এক সাথে দেখা মিলবে ভোলার চর কুকরি-মুকরি, ঢালচর ও মনপুরাতে। চরগুলোতে যাতায়ত, থাকা, এমনকি সুপিয় পানির পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা নেই, তাই নিজ উদ্যেগেই এ সমস্ত ব্যাবস্থা করে এখানে আসতে হয়। তার পরেও প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য দেখতে কষ্ট ও বিড়ম্বনা সহ্য করে বহু পর্যটক এসে ভিড় জমিয়েছেন ভোলার এ সমস্ত চরগুলিতে।

সারি সারি সিসি ব্লক, বেড়িবাঁধের ওপর ছোট-বড় বেঞ্চ ও গোলাকার ছাউনি। নদীর উত্তাল ঢেউ, প্রকৃতির নির্মল বাতাস আর সূর্যাস্ত নিয়ে ভোলার চরফ্যাশনে গড়ে উঠেছে ‘বেতুয়া প্রশান্তি পার্ক’। উপজেলার পূর্ব প্রান্তে মেঘনা নদীর তীরে পার্কটির অবস্থান। দর্শনার্থীদের বিনোদনের অন্যতম একটি কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্কটি। নির্মল বাতাস আর বাহারি নৈসর্গিক প্রকৃতি, আগতদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। দর্শনার্থীরা এখানে এসে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানো, নদীতে নৌকাভ্রমণ, বাঁধের ওপর সিসি ব্লকের ওপরে দাঁড়িয়ে নদীর বুকে সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ পান।

পার্কটিতে উন্মুক্ত প্রবেশপথ থাকায় যে কেউ সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারেন। পার্কটিতে দর্শনার্থীদের পদচারণা থাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। একই সঙ্গে জ্যাকব টাওয়ার, শেখ রাসেল শিশু ও বিনোদন পার্কেও দর্শনার্থীরা ভিড় জমান।

ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের উপকন্ঠে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর মোহনায় গড়ে উঠা চর কুকরি-মুকরিতেই রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বন্যপ্রানীর অভায়ারন্য। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল ক্যানভাস স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরিকে সাজিয়েছে সাজের সমারোহে। চিত্রা হরিন, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বন্য মহিষ-গরু বন বিড়াল, ইত্যাদি, আর পাখি ও সরিসৃপ হিসাবে বিভিন্ন প্রজাতির বক, বন মোড়গ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ুর , কোয়েল, গুইসাপ, বেজি, কচ্ছপ ইত্যাদি প্রানী চর কুকরি-মুকরির বনে দেখা যায়। কুকরি-মুকরির প্রধান আকর্ষন সাগর পাড়, এখানে উত্তাল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখলেই মনে পড়ে যাবে কক্সবাজার কিংবা সমুদ্র সৈকতের কথা, এছাড়া ও এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত ও সূর্য ডোবার দৃশ্য ভ্রমন পিপাসুদের মুগ্ধ করবে।

ইতোমধ্যেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, ক্যাম্পিং করার জন্য প্রশস্ত বিচ আর নিরব শান্ত পরিবেশের জন্য পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এটি। পাশেই আছে মনপুরা। ঘন বন, লোকালয়ের কোলাহল থেকে দূরে, নানা বণ্যপ্রাণির অবাধ বিচরণের মাঝে প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্য পেতে প্রায়ই এখনে ভ্রমণ করেন অসংখ্য মানুষ।

চর কুকরি-মুকরিতে বরিশাল থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক শফিক খান বলেন, এই জায়গাটা খুবই সুন্দর, প্রশস্ত বিচ, বিভিন্ন ধরনের পশু পাখি দেখতে খুব ভালো লাগছে, তবে, এখানে আসা যাওয়ার রাস্তা খুবই খারাপ, স্পিড বোট, লঞ্চে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দেখতে যেতে হলে অধিক টাকা ভাড়া দিতে হয়। একটি ভালো লঞ্চের ব্যাবস্থা থাকলে পর্যটকদের এখানে আসার আগ্রহ ও বিভিন্ন এলাকার সাথে যোগাযোগ বেড়ে যেতো।

ভোলা জেলার সর্বদক্ষিণের দ্বীপের নাম ঢালচর। এটি চরফ্যাশন উপজেলার অন্তর্গত একটি ইউনিয়ন। দেশের বৃহত্তম দুটি সমুদ্র সৈকতের পরে ঢালচর দ্বীপের তারুয়া এলাকাটি তৃতীয় সমুদ্র সৈকত হিসেবে স্থান পেতে পারে বলে জানিয়েছেন ভ্রমণকারীরা।

প্রকৃতিপ্রেমি মো: সানি বলেন, তারুয়ার পুরো দ্বীপটি দেখার স্বাদ যেন অপূর্ণ-ই রয়ে যায় কারো কারো। যে প্রান্তেই চোখ যায় সেদিকেই যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্য। দ্বীপজেলায় এমন প্রকৃতিক সৌন্দের্যের লীলাভূমি রয়েছে তা স্ব-চক্ষে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেনা।

ভোলা থেকে প্রায় ৮০ কিঃ মিঃ দুরত্বে সাগরের বুকে নয়নাভিরাম আরেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ প্রাকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি মনপুরা। এখানে সকাল বেলার সূর্য যেমন হাসতে হাসতে পুর্বদিকে ডিমের লাল কুসুমের মত উদিত হতে দেখা যায়, তেমনি বিকেল বেলাতেও আকাশের সিঁড়ি বেয়ে লাল আভা ছড়াতে ছড়াতে পশ্চিম আকাশে মুখ লুকায়। মনপুরাতে এসেই কেবল সুর্যোদয় ও সুর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করা যায়। মনপুরার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ম্যনগ্রোভ প্রজাতির সারিসারি বাগান।

জানা যায়, চর কুকরি মুকরি ১৯১২ সালের দিকের জেগে ওঠে। কথিত আছে, একসময় চর কুকরি মুকরিতে শুধু কুকুর আর ইঁদুরের বাস ছিল। স্থানীয়দের কাছে যা মেকুর নামে পরিচিত। এ কারণেই চরের নামকরণ করা হয় কুকরি মুকরি।

১৯৮৯ সালের ১৪ মে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার একর জমিতে সংরক্ষিত শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষের বনায়ন শুরু হয়। চর কুকরি মুকরির বনভূমিতে স্থান পেয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, কেওড়া, নারিকেল, বাঁশ ও বেত।

বর্তমানে কুকুরি মুকুরি চরে বনভূমির পরিমাণ ৮ হাজার ৫৬৫ হেক্টর, যার মধ্যে ২১৭ হেক্টর জমি বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম। বসতি ও কৃষি আবাদর জন্য প্রায় ৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমি রয়েছে। মাছ ধরা ও কৃষিকাজ চর কুকরি মুকরিতে বসবাসকারী মানুষের প্রধান পেশা।

চরফ্যাশন থেকে গাড়ি,অটোরিকশা,মোটরসাইকেল যোগে কচ্ছপিয়া খেয়াঘাট যেতে হয়। খেয়া পার হলেই চর কুকরি-মুকরি সেখান থেকে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে মোটরসাইকেলও অটোরিকশা ম্যানগ্রোভ বন পর্যন্ত পৌঁছে দিবে। এরপর পায়ে হেঁটে আধা ঘন্টা মারিয়েই পৌঁছাতে হয় চর কুকরি মুকরিতে। সেখান থেকে টাকার বিনিময়ে খেয়া পার হয়ে নারকেল বাগান পর্যন্ত পথ চিনিয়ে দেবে তারা। ম্যানগ্রোভ বন পেরিয়েই ঘাট, ছোট্ট একটি খেয়া পার হলেই নারকেল বাগান ক্যাম্পিং সাইট।

সেখান থেকে তারুয়া সমুদ্র সৈকত যেতে চাইলে ট্রলার পাবেন। ৩ হাজার টাকা রিজার্ভ ট্রলার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন সময় করে ভার্জিন বিচ খ্যাত তারুয়া থেকে। যারা চর কুকরি মুকরিতে পেছনে বিস্তার বন, আর সামনে অকূল দরিয়া। আর এর মাঝেই ছায়া ঘেরা, বৃক্ষরাজির নিচে যারা ক্যাম্পিং করতে চান তারা টাঙাতে পারেন টেন্ট । বণ্যপাণীদের অভয়ারণ্য হলো এই চর। সেখানে যেসব প্রাণী দেখা যায় তার মধ্যে আছে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বন্য মহিষ-গরু, বন-বিড়াল, বন মোরগ, প্রভৃতি।

আর পাখি ও সরিসৃপ হিসেবে এই বনের অধিবাসীদের মধ্যে আছে বিভিন্ন প্রজাতির বক, বন মোরগ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েল, গুইসাঁপ, বেজি, কচ্ছপ, কুকুরি বনের ও নানা ধরনের সাপ। এই চরে শীতকালের চিত্র ভিন্ন ধরনের। সূদুর সাইরেরিয়া থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখিদের আগমনে চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারণ করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এর মধ্যে সিংহভাগই ভোলায় অবস্থান করে। তখন স্বপ্নের দ্বীপ কুকরিমুকরি এর চর অতিথি পাখিদের অভয়ারন্যে পরিণত হয়।

ঢাকা থেকে চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাট পর্যন্ত লঞ্চ রুটে যাওয়া ও আসার ভাড়া কিন্তু ভিন্ন। যাওয়ার সময় ডেক ভাড়া ৪০০ হলেও ফেরার সময় ৩০০ টাকা। সিঙ্গেল কেবিন ১২০০ ও ডাবল কেবিন ২৪০০ টাকা।

বেতুয়া ঘাটে নেমে চর কুকরি মুকরিতে যাওয়ার দুই উপায়। প্রথমটি হলো, অটো নিয়ে চলে যেতে হবে চরফ্যাশন বাস টার্মিনালে। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। সময় লাগবে ৩০-৪০ মিনিট। চরফ্যাশন থেকে আপনি চর কচ্ছপিয়া যাওয়ার জন্য পাবেন দক্ষিণ আইচার বাস। ভাড়া জন প্রতি ৪০ টাকা। সময় লাগবে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা। এছাড়াও মোটর সাইকেলে যেতে পারবেন ভাড়া জন প্রতি ১৫০ টাকা।

বাস থেকে নেমে আবার অটো বা রিকশায় জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়ায় কচ্ছপিয়া ঘাটে পৌঁছে যাবেন। তবে অনেকে সরাসরি বোরাক নামক রিকশা রিজার্ভ করেই ছুটেন কচ্ছপিয়া ঘাট। ৪-৫ জন বেশ সহজেই আরাম করে বসা যায় রিকশায় ভাড়া ৪০০-৫০০ টাকা।

চর কচ্ছপিয়া থেকে চর কুকরি মুকরি যাওয়ার উপায় মূলত দুটি। জনপ্রতি ১৫০ টাকা ভাড়ায় ট্রলারে যেতে পারেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা ও দুপুর ১২টায় লোকাল ট্রলার চর কুকরি-মুকরির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। স্প্রিট বোটে জন প্রতি ভাড়া ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। রিজার্ভ নিলে ৩ হাজার টাকা। দুই পাশের ম্যানগ্রোভ বন কাটিয়ে যখন আপনি ছুটে চলবেন, তখন উপভোগ করবেন স্বর্গসুখ! ট্রলারে ১ ঘণ্টার বেশি সময় লাগলেও স্পিড বোটে এই জার্নি মাত্র ২০ মিনিটের।

চর কুকরি মুকরিতে ক্যাম্পিং না করেও রাত কাটাতে পারবেন। চরফ্যাশনের এমপি জনাব জ্যাকব সরকারি অর্থায়নে রেষ্ট হাউজ করেছেন। যায় প্রতিটি রুমের ভাড়া ২০০০ টাকা ও ৫০০০ টাকা।

এছাড়া খুব স্বল্প মূল্যে রাত কাটাতে পারেন হোম স্টেশন গুলোতে। তবে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে টেন্টে ক্যাম্পিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো তাই সে বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

7 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন