১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

ভোলায় সংখ্যালঘুদের কোটি টাকার জমি জবর দখলে মরিয়া প্রভাবশালী চক্র

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:৩৫ অপরাহ্ণ, ১৪ মে ২০২২

ভোলায় সংখ্যালঘুদের কোটি টাকার জমি জবর দখলে মরিয়া প্রভাবশালী চক্র

ভোলার চরফ্যাসন ও লালমোহন:: চরফ্যাসন:: ভোলার চরফ্যাসন ও লালমোহনে ভারতীয় নাগরিক প্রবীর দাস, সুবির দাস ও উত্তম দাসকে ব্যববহার করে সংখ্যালঘুদের বিপুল জমাজমি জবরদখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাধর প্রভাবশালী একটি চক্র। লালমোহন উপজেলার রমাগঞ্জ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার এবং ইউনিয়ন যুুবলীগের সভাপতি মোসলে উদ্দিন লিটনের নেতৃত্বে এই চক্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তায় জালজালিয়াতির মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকরা দেশান্তরের অর্ধশত বছরের বেশী সময় পরে চরফ্যাসন ও লালমোহনে ভোটার হয়েছেন এবং বাংলাদেশী নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন। ওই প্রভাবশালী চক্রের অপতৎপরতার ফলে একাধিক মামলা মোকদ্দমার উদ্ভব হয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশ এবং প্রশাসনের সব ভুমিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রভাবশালীরা ভারতীয় নাগিরক ওই তিন ভাইকে সামনে রেখে সংখ্যালঘু অনিমা রানী দাসের সাড়ে ১০ একর জমিদখল করে মাটিকাটা, গাছ লাগানোসহ ঘর তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। পাশাপাশি জমির প্রকৃত মালিক সংখ্যালঘু অনিমা রানী দাসের পরিবারকে দেশত্যাগের জন্য হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। প্রভাবশালীদের অব্যাহত হুমকি আর জবর দখলের মুখে সংখ্যালঘু পরিবারটি অসহায় হয়ে পরেছেন বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চরফ্যাসন পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের জিন্নাগড় মৌজা এবং লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের পেয়ারী মোহন মৌজার ১৮ একর জমির মালিক ছিলেন রাজ নারায়ন। রাজ নারায়ন থেকে ১৯৫৬ সনে পত্তনমূলে সমুদ্বয় সম্পদের মালিকানা অর্জন করেন চারুবালা ভৌমিক। পত্তনের শর্তানুযায়ী রাজ নারায়ন ওই জমির নিজনামীয় রেকর্ড সংশোধন করে চারুবালা ভৌমিকের নামে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্ত রেকর্ড সংশোধন না করায় এবং রাজ নারায়ন ভারতে চলে যাওয়ায় ওই সম্পত্তি ভিপি সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ক্রেতা চারুবালা ভৌমিক এবং চারুবালা ভৌমিক থেকে ক্রেতা অনিমা রানী দাস সরকারের ওই ভিপি আদেশের বিরুদ্ধে ভোলার সাব জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। যা বর্তমানে উচ্চ আদালতে চারুবালার অনুকূলে রিভিশন মঞ্জুর হয় এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে ভোলার ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলাটি চলমান আছে। মামলা চলমান অবস্থায় (হস্তান্তরে আদালতের কোন বিধিনিষেধ না থাকায়) চারুবালা ভৌমিক ১৯৮৬ সনে লালমোহনের পেয়ারী মোহন মৌজার এস এ ২৪ ও এস এ ২৭ খতিয়ানের বিভিন্ন দাগের ১০ একর ৫০ শতাংশ জমি চরফ্যাসন সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ২৮৯৫ এবং ২৮১৬ নং দলিলমূলে অনিমা রানী দাসের কাছে বিক্রি করেন। সে থেকে অনিমা রানী দাস ওই জমি ভোগ দখল করে আসছেন।

জানা গেছে, ১৯৫৬ সনে দেশান্তরিত মূল মালিক রাজ নারায়নের একমাত্র ছেলে ছিলেন কালি মোহন দাস। কালিমোহন দাসের তিন ছেলে প্রবীর দাস, সুবির দাস এবং উত্তম দাসের জম্ম ভারতে এবং তারা ভারতে বসবাস করছেন। সম্প্রতি প্রবীর দাস চরফ্যাসন ও লালমোহনে এসে উত্তরাধীকার সূত্রে এবং বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক হিসেবে নিজেদের ওই জমির মালিকানা দাবি করলে ক্রেতা এবং ভোগদখলীয় সংখ্যালঘু পরিবারগুলো বেকায়দায় পড়েছে।

চারুবালা দাস থেকে ক্রয়সূত্রে মালিক অনিমা রানী দাস অভিযোগ করেন, লালমোহনের রমাগঞ্জ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর এবং ওই ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মোসলে উদ্দিন লিটনের নেতৃত্বে একটি প্রভাবশালী চক্র ভারতীয় এসব নাগরিককে জালজালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশে ভোটার এবং নাগরিকত্ব অর্জনে সহায়তা করেন। এই চক্রের অবৈধ কর্মে অর্থের যোগান দাতা ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে কোটিপতি ধনকূবের হয়ে ওঠা আহমদ উল্যা। আহমদ উল্যাহ এবং মোসলে উদ্দিন লিটনরা ভারতীয় ওই নাগরিকদের ব্যবহার করে নিজেরাই এসব জমি জবর দখল করতে পেছন থেকে কাজ করছে। লালমোহনের পেয়ারী মোহন মৌজায় অনিমা রানী দাসের জমিতে মাটিকাটা, গাছপালা লাগানো এবং ঘর তুলে জবর দখলে এই চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন বলে সংখ্যালঘু ভুক্তভোগী পরিবারটি অভিযোগ করেছেন। সংখ্যালঘু পরিবারগুলো প্রভাবশালীদের থাবায় তাদের জমি জমা থেকে উচ্ছেদের ঝুকিতে পড়েছে।

ভারত থেকে প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণে জানা যায়, দাদা রাজ নারায়ন ১৯৫৬ সনে একমাত্র পুত্র কালিমোহন দাসকে নিয়ে ভারতের দক্ষিণ ২৪ পরগোনা জেলার বাসন্তী থানার হরেকৃষ্ণপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন এবং সেখানে স্থায়ী হন। সেখানে কালিমোহন দাস স্ত্রী লিলাবতী দাসকে বিয়ে করেন। কালিমোহন দাস ও নীলাবতী দাসের তিনপুত্র- প্রবীর দাস, সুবির দাস এবং উত্তম দাসের জম্ম ভারতের ওই হরিকৃষ্ণপুর গ্রামের পৈত্রিক বাড়িতে। বাসন্তী থানার জ্যোতিষপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রবীর দাস ৩৩৩ নং, সুবিরদাস ৩৩৫ নং এবং উত্তম দাস ৩৩৬ নং ভোটার। প্রবীর দাসের স্ত্রী রিতা রাণী দাস ৩৩৪, উত্তম দাসের স্ত্রী সুবর্ণাদাস ৩৩৭ এবং সবিরদাসের স্ত্রী পিংকিং দাস ৩৩৮ এবং তাদের মা নীলাবতী দাস ৩৩২ নম্বর ভোটার। তিন ভাইয়ের স্ত্রীদের পৈত্রিক বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বিভিন্ন গ্রামে। তাদের বাবা কালিমোহন দাস ওখানে রেশনভোগকারী বলে তথ্য প্রমাণ আছে। পাশপাশি প্রবীর দাস ভোলার লালমোহন উপজেলার সেকান্তর মেম্বারের বাড়িকে নিজের ঠিকানা দেখিয়ে ২০১৩ সনে প্রথম বাংলাদেশে ভোটার হন। সংখ্যালঘুদের ওই জমি জবর দখলের মূলহোতা রমাগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি এবং ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার মোসলে উদ্দিন লিটনের বাবার নাম সেকান্তর। তাদের বাড়িকে প্রবীর দাসের ঠিকানা দেখিয়ে ঠিকানাবিহীন ভারতীয় এই নাগরিককে বাংলাদেশে ভোটার এবং নাগরিকত্ব অর্জনে সহযোগিতা করেন এই যুবলীগ নেতা মোসলে উদ্দিন লিটন মেম্বার। ভোলার লালমোহন উপজেলার রমাগঞ্জ ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ৩১৪ নং ভোটার প্রবীর দাস। একই ভাবে ২০১৩ সনে চরফ্যাসন পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের ভোটার হন সুবির দাস ও উত্তম দাস। তিন ভাই ২০১৩ সনে বাংলাদেশে ভোটার হয়ে নাগরিকত্বের কার্ড সংগ্রহ করেন। ভোটার তালিকানায় তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সর্বোচ্চ ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখা হলেও কোন প্রতিষ্ঠানে তারা লেখাপড়া করেছেন এমন কোন তথ্য প্রবীর দাস নিজেও জানেন না।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় প্রবীর দাসের বয়স ৭৫ বছর দেখানে হলেও ভারতীয় ভোটার তালিকায় তার বসয় দেখানে হয়েছে ৫৪ বছর। ভারতীয় ওই ভোটার তালিকায় তার মা লীলাবতী দাসের বয়স দেখানো হয়েছে ৬৭ বছর। মূলত পূর্ব পুরুষ দাদা রাজ নারায়নের বিক্রি করে যাওয়া অর্ধশত কোটি টাকা দামের সম্পদ বাগিয়ে নেয়ার অশুভ উদ্দেশে এই তিনভাই স্থানীয় ভূমিদস্যু প্রভাবশালী একটি সংঘবদ্ধ চক্রের দ্বারা প্রভাবত হয়ে অসৎভাবে তথ্য গোপন করে ঠিকানাবিহীন এই বাংলাদেশে এসে নাগরিকত্ব অর্জন করেন। এদের নাগরিকত্ব অর্জনে মিথ্যা তথ্য তৈরী এবং ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিতে প্রভাবশালী ওই চক্র সহযোগিতা করেছেন বলে তথ্যপ্রমাণ মিলছে।

নাগরিকত্ব অর্জনের পরপর প্রবীর দাস চরফ্যাসন সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ১০৭/২০১৬ মোকদ্দমা দাখিল করে জমির মালিকানা দাবি করেন। ওই মোকদ্দমার আদেশে বিজ্ঞ আদালত বলেছেন- বাদি প্রবীর দাস অধিকাংশ সময় ভারতে থাকেন। তার অপর দুই ভাই সুবির দাস ও উত্তম দাস স্থায়ী ভাবে ভারতে বসবাস করেন। তাই মামলাটি তদ্বিরের অভাবে বাদি প্রবীর দাসের বিপক্ষে খারিজ করা হয়। যদিও ২০০১ সনের ১২ ফেব্রুয়ারী দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার আলিপুর আদালতে ঘোষণাপত্রে প্রবীর দাসদের বাবা কালিমোহন দাস ঘোষণা করেন যে, বর্তমানে (২০০১সনে) তিনি স্ত্রী-পুত্রসহ ভারতের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বাসন্তী থানার হরে কৃষ্ণপুর গ্রাসে বসবাস করছেন। ভোলার লালমোহন উপজেলা এবং চরফ্যাসন উপজেলায় পিতা রাজনারায়ন দাসের নামে কোন জমির রেকর্ড থাকিলেও ওই জমিতে তার বা তার বাবার আদৌ কোন স্বত্তদখল নাই বা ছিল না এবং ভবিষ্যতেও কোন দাবী দাওয়া করিব না মর্মে ভারতের আলীপুর নোটারী কার্যালয়ে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দেন কালিমোহান। বর্তমানে স্বর্গীয় কালিমোহন দাসের দুইপুত্র প্রবীর দাস ও সুবীর দাস ওই ঘোষণাপত্রে সাক্ষ্য দেন। জমির দাবিদার প্রবীর চন্দ্র দাস ভারত থাকায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।

তবে জমি জবর দখলকারী ইউপি সদস্য মোসলেউদ্দিন লিটন জানান, অনিমা রানীর ভাশুর খোকন কর্তা ওই জমি প্রবীর দাসকে লিখিত ভাবে দখল দেয়। এবং প্রবীর দাস ওই জমিতে আবাদ করছে। আমি জবর দখল করেছি বিষয়টি সঠিক নয়। উভয়ের বিপত্তি শুরু হলে আমি বিষয়টি সমোঝতার চেষ্টা করেছি।’

 

10 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন