২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

ভোলা শহর রক্ষা বাঁধে বিশাল দুর্নীতি, তদন্তে মিলেছে প্রমাণ

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৩৮ অপরাহ্ণ, ১৪ জানুয়ারি ২০১৯

ভোলার চরফ্যাশন ও মনপুরা শহর রক্ষা বাঁধে ১৬৮ কোটি টাকার দুই প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

৮ বছর আগে এ দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব সিসি ব্লক নির্মাণ করা হয়, তার মধ্যে প্রায় এক লাখই ছিল নিম্নমানের, যা এখনও পড়ে আছে ভোলার চরফ্যাশনের চরে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) টাস্কফোর্সের প্রবল আপত্তির মুখে দুর্নীতিবাজ চক্রটি শেষপর্যন্ত নিম্নমানের ব্লক বাঁধে ব্যবহার করতে পারেনি।

কিন্তু টাস্কফোর্সের আপত্তি উপেক্ষা করে ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হয়। এরপর দীর্ঘসময় পার হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং ওই সময়ে ভোলায় কর্মরত পাউবোর ৭ কর্মকর্তার কয়েকজন পদোন্নতিও পেয়েছেন। সম্প্রতি এক তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্নীতি-অনিয়মের চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য উঠে আসে। এ অবস্থায় ঠিকাদারকে দেয়া প্রায় আড়াই কোটি টাকা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর একনেক সভায় ভোলায় চরফ্যাশন ও মনপুরা শহর সংরক্ষণ প্রকল্পের মূল ডিপিপি অনুমোদন হয়। প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১৪২ কোটি ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। বাস্তবায়নকাল ছিল ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর তিন দফায় প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। প্রকল্প এলাকায় অব্যবহৃত ব্লকগুলো ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুনে তৈরি করা হয়। প্রকল্প দুটিতে মূলত ব্লক নির্মাণে ভয়াবহ দুর্নীতি হয়।

দুটি প্রকল্পে মোট ২৯টি প্যাকেজ ছিল। এর মধ্যে ১৫টিই ছিল ব্লক তৈরি ও ডাম্পিংয়ের কাজ। নদী ভাঙন ঠেকাতে দরপত্রে উন্নতমানের ব্লক ও জিও ব্যাগ তৈরির শর্ত দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা শর্ত ভঙ্গ করে খুবই নিম্নমানের ব্লক তৈরি করে।

এ কারণে ২০১১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পাউবোর টাস্কফোর্স আহ্বায়ক কাজী তোফায়েল হোসেন তৎকালীন চিফ মনিটরিংয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তিনিই এখন চিফ মনিটরিংয়ের দায়িত্বে আছেন।

নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাবস্থায় এই টাস্কফোর্স প্রধান কাজী তোফায়েল হোসেন অফিসিয়াল অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন- ‘ভোলার সংশ্লিষ্ট দুটি প্রকল্প এলাকার কাজ পরিদর্শন করা হয়। এ সময় কয়েকটি লটের জিও ব্যাগ পরীক্ষাকালে অধিকাংশ ব্যাগের মান খারাপ পাওয়া যায়।’

ওই অভিযোগপত্রের এক স্থানে বলা হয়- ‘কাজের ডিজাইনে জিও ব্যাগের পুরুত্ব হওয়ার কথা ছিল ৩ মিলিমিটার। বিভিন্ন লটের ৬টি জিও ব্যাগ পরীক্ষার জন্য বুয়েটে পাঠানো হয়। কিন্তু ঠিকাদাররা যে জিও ব্যাগ ব্যবহার করে তা ২ মিলিমিটার বা ২.৫ মিলিমিটার।’

এছাড়া জিও ব্যাগে যে বালু ভরার কথা ছিল সেখানেও নিম্নমানের বালু ব্যবহারের প্রমাণ পায় টাস্কফোর্স। এ বিষয়ে বলা হয়- ‘হাজার হাজার ঘনমিটার বালু বাইরে থেকে দেখেই খারাপ মনে হওয়ায় রিভার রিসার্স ইন্সটিটিউট (আরআরআই) বরিশাল ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।

টেস্ট রিপোর্টে দেখা গেছে, ডিজাইনের চেয়ে অনেক কম ক্ষমতাসম্পন্ন বালু সংগ্রহ করা হয়েছে। এফএম-১ (উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন) মানের বালু দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে ০.৩৩ এফএম।’ একজন কর্মকর্তা জানান, এসব বালু ছিল মাটি মিশ্রিত, যা পানিতে থাকলে গলে বেরিয়ে যাবে।

এদিকে তৈরিকৃত সিসি ব্লকের মানও খারাপ পায় টাস্কফোর্স। কাজী তোফায়েলের প্রতিবেদনে ব্লকের বিষয়ে বলা হয়- ‘বিভিন্ন প্যাকেজে তৈরি করা সিসি ব্লকের মান ভালো মনে হয়নি। এগুলো বুয়েটের পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীকে অনুরোধ করা হয়। সার্বিকভাবে কাজের অগ্রগতি এবং গুণগতমান অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে হয়েছে। স্পেসিফিকেশনবহির্ভূত যে ধরনের জিও ব্যাগ এবং বালু সংগ্রহ করা হয়েছে তা দিয়ে ডাম্পিং করা যাবে না।

এ কারণেই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কাজেই জরুরিভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া না হলে এ বছর (২০১১) ডাম্পিং কাজের কোনো অগ্রগতি হবে না। এমনকি প্রকল্প এলাকা মারাত্মকভাবে ভাঙনের সম্মুক্ষীণ হবে।’

কাজী তোফায়েলের এই প্রতিবেদনের পর প্রকল্পের ৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। কর্মকর্তারা হলেন- তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার, এসএম আতাউর রহমান, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান, নাহিদ-উজ-জামান, উপসহকারী প্রকৌশলী শাহ মো. আমিনুল ইসলাম, মো. আশরাফুল সিদ্দিকী ও মো. নুর হোসেন। কিন্তু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

বরং ওই সময়ে ভোলায় প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার পদোন্নতি পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হয়েছেন। সর্বশেষ গত বছর সিলেটে কর্মরত অবস্থায় নুরুল ইসলাম সরকার হাওর রক্ষা বাঁধে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন। ওই একই সময় ভোলায় উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী থাকা হাসানুজ্জামান পদোন্নতি পেয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী হয়েছেন।

ওই বিভাগীয় মামলার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাউবোর শৃঙ্খলা শাখা থেকে এ বিষয়ে বিভাগীয় মামলার যে নথি খোলা হয়, সেটিই গায়েব হয়ে গেছে। দফায় দফায় চিঠি চালাচালি করেও ওই নথির কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। নথি গায়েব হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে গত ২ আগস্ট একটি সার্কুলারও জারি করেন পাউবোর শৃঙ্খলা পরিদফতরের পরিচালক ফেরদৌসি বেগম।

ব্যয়বহুল দুই প্রকল্পের কাজের এ ধারাবাহিকতায় গত ৫ এপ্রিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হাওলাদার জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- পাউবোর চিফ মনিটরিং কাজী তোফায়েল হোসেন ও ডিজাইন সার্কেল-২ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হারুন অর রশীদ। কমিটি ১৮ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দুটি প্যাকেজের জিও ব্যাগ প্লেসিং (নদীরপাড় ব্লক করা) ও ডাম্পিং (ভাঙন ঠেকাতে নদীর গভীরে বালির বস্তা ও ব্লক ফেলানো) বিষয়ে গরমিল পাওয়া যায়। এছাড়া প্রাকৃতিক বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কাজের পরিবেশও ছিল না। নদীর গতিপথ পরিবর্তন, প্রকল্প কাজে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী ও শ্রমিকের মজুরি বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়া, আর্থিক বছরে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকা, এক প্যাকেজের বরাদ্দ দিয়ে অন্য প্যাকেজের কাজ বাস্তবায়ন ও নির্ভরশীলতা, প্রকল্প কাজে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, মাঠপর্যায়ে সমন্বয়হীনতা, দুটি প্যাকেজের ঠিকাদার স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ না করা ও ঠিকাদার-কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থার অভাবসহ নানা জটিলতার কারণে রুগ্ন প্রকল্পে পরিণত হয়।

একপর্যায়ে তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কার্যাদেশ বাতিল করে ২০১৬ সালে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। ২০১৭ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে কাজ শেষ করতে গিয়ে স্টক পাইলের (জরুরি প্রয়োজনের জন্য বরাদ্দ রাখা) ব্লকগুলো বিতর্কিত দুটি প্যাকেজের ডাম্পিং ও প্লেসিং কাজে ব্যবহার করে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বা বাঁধ এলাকায় যে কোনো ধরনের বিপর্যয় দেখা দিলে হুমকির মুখে পড়বে গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি বাঁধ। জরুরি প্রয়োজন মেটানোর ভালো কোনো সিসি ব্লক সেখানে নেই।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ‘ঢাকার মুগদাপাড়ার মেসার্স ডন কর্পোরেশন, ফেনীর মহিপালের মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ, রাজশাহীর মেসার্স খন্দকার কন্সট্রাকশন ও ঢাকার নিকেতনের ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড নিম্নমানের ব্লক তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই ঠিকাদারদের তৈরিকৃত নিম্নমানের ব্লকের মূল্য পরিশোধ করেন। এমনকি সরকারের আইএমইডির (বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) প্রতিবেদনেও সিসি ব্লকগুলো নিম্নমানের বলে উল্লেখ করা হয়।’

0 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন