২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

মাদকে সয়লাব উজিরপুর, চিহ্নিত বিক্রেতারাই পুলিশের সোর্স!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:৫৭ অপরাহ্ণ, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

জহির খান উজিরপুর:: দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযান চালাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহসী সদস্যরা বিপুল পরিমান মাদক উদ্ধার ও মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার করছে।

কোথাও আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে অনেক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা নিহত হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের মাদকদ্রব্য। সেই অনুযায়ী বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় সংশ্লিষ্ট থানার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

মাদকের অভয়ারন্য উজিরপুর পৌরসভাসহ ৯টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে টাকা হলে হাতের নাগালেই পাওয়া যায় ইয়াবা ও গাঁজা। তবে থানা পুলিশ বরাবরই মাদকসেবী গ্রেপ্তারে তৎপর থাকলেও বিক্রেতাদের নয়। কারন বিক্রেতাদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কতিপয় নেতাকর্মীরা জড়িত রয়েছে।

এক সময় দেশের সীমান্ত এলাকাগুলো থেকে এ উপজেলায় ফেন্সিডিল প্রবেশ করতো। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাদকের নতুন সংস্করণ ইয়াবা প্রবেশ করছে। গোটা উপজেলা জুড়ে এই ইয়াবা এতটাই সয়লাব করেছে যে, স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সীরা এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

এমনকি শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও গাড়ি চালকদের মধ্যেও ইয়াবার বিস্তার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ভবিষ্যত তরুণ শ্রেণীর মধ্যে ইয়াবা আসক্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে উজিরপুর মডেল থানা পুলিশ রয়েছে প্রায় নীরব ভূমিকায়।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই উজিরপুর পৌরসভার বেলতলার মোড়, লিচুতলা, রাখালতলা নীলখোলা, উত্তর রাখালতলা, কালিরবাজার, উজিরপুর খেয়াঘাট, হাসপাতালের মোড়, ইচলাদী বাসস্ট্যান্ড, সোনার বাংলা, ডাকবাংলো, টেম্পুস্ট্যান্ড, টিএনটির মোড়, কুমার বাজার, পরমানন্দসাহা ও উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে।

এছাড়া উপজেলার শিকারপুর বন্দর, সানুহার বাসস্ট্যান্ড, জয়শ্রী, আটিপাড়া সুলতানের দোকান সংলগ্ন এলাকা, কালিহাতা, মানিক বাজার, হস্তিশুন্ড ঈদগাহ মার্কেট, খোলনার মোড়, গড়িয়া নতুনহাট, চৌমহনী বাজার, কাজিরা, ডাবেরকুল, ওটরা, মশাং বাজার, বামরাইল, মোড়াকাঠি, গুঠিয়া বন্দর, নারায়নপুর বাজার, শোলক, হারতা, মুন্সিরতাল্লুক, জল্লা পীরেরপাড়, কারফা বাজার, সাতলা, নয়াকান্দি, বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের মেজর এম এ জলিল সেতুর নীচসহ বিভিন্ন এলাকার কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০টি স্পটে নিয়মিত মাদকের বিক্রি চলছে।

এসব স্পটের মাদক ব্যবসার সাথে বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কোনো না কোনো নেতা জড়িয়ে রয়েছে। ফলে এ উপজেলায় মাদকের বিস্তার ঠেকানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

এছাড়াও উজিরপুর পৌরসভা এলাকায় বর্তমান সময়ে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাহীন ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রদলের কতিপয় স্থানীয় নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন দলের অসাধু কিছু নেতাদের সাথে গোপনে ঐক্য রেখে ইয়াবার ব্যবসা চালিয়ে আসছে। ধ্বংস করছে এলাকার তরুন ও যুব সমাজ।

এদিকে মাদকের প্রসার এবং এর সাথে জড়িতেদের নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে কিছুদিন রাখঢাক করে মাদক বেচাকেনা হয়। তারপর আবার তা পুরোদমে চলতে থাকে। অনুসন্ধানে এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা, তাদেরই কতিপয় সদস্য কিংবা কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা অবাধে ব্যবসা করে চলছে।

অভিযোগ রয়েছে, একাধিক মাদক মামলার আসামী পৌর সদরের চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রাব্বি ও তার সহোদর ভাই লাভলুর সাথে সংশ্লিষ্ট থানার এক শ্রেণীর পুলিশ সদস্যের নিয়মিত যোগযোগ রয়েছে। তারা (পুলিশ) ওই দুই মাদক ব্যবসায়ীকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে মাঝে মধ্যে কিছু সেবনকারী গ্রেফতার করে।

এরপর ওইসব সেবনকারীদের মামলা দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রনের নাটক করছে। আবার কাউকে আটক করে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে ছেড়ে দিয়ে বানিজ্য করছে। যার কারনে পুলিশের কতিপয় সদস্যদের সাথে গোপন ঐক্যের দাপটে ওই দুই মাদক বিক্রেতা ভাই ও তাদের একমাত্র সহযোগী হাসান প্রকাশ্যে গোটা পৌর এলাকায় ইয়াবা ছড়াচ্ছে।

তাছাড়া মাদক ব্যবসায়ী রাব্বি বালী গত কয়েকমাস আগে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বরিশাল জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট আত্মসমর্পন করে। কিন্তু এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে রাব্বি আত্মসমর্পনের পর থেকে পুন:রায় মাদক ব্যবসা শুরু করেছে। বর্তমানে সে পৌর সদরে পুরোদমে ইয়াবার রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছে।

পৌর সদরের একটি গোপন সূত্রের দাবী, সংশ্লিষ্ট পৌরসভায় পুলিশের যে কর্মকর্তা দায়িত্বে রয়েছেন তিনি এলাকার চিহ্নিত সকল মাদক ব্যবসায়ীদের সোর্স হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওই সকল বিক্রেতাদের দিয়ে সেবনকারীদের আটক করে ঘুষ বানিজ্য করে আসছেন।

এর ফলে কোনোভাবেই এ উপজেলার মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিন আবিষ্কার হচ্ছে নতুন নতুন মাদক বিক্রেতা। এসব মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের এমন উদাসীনতায় দিন দিন মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে এলাকার বেকার যুবকরা। তাই অতিদ্রুত মাদক নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী।

এ ব্যাপারে পৌর এলাকায় দায়িত্বরত উজিরপুর মডেল থানার সহকারি উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মহাসিন এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ‘চিহ্নিত মাদক বিক্রেতা রাব্বি ও তার ভাই লাভলু দীর্ঘ দিন ধরেই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। কোনো সময়ই তারা পুলিশের সোর্স ছিলোনা।’

এএসআই মহাসিন আরও জানান, ‘সম্প্রতি কয়েকমাস পূর্বে মাদক বিক্রেতা রাব্বি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট আত্মসমর্পন করেছে এবং বর্তমানে রাব্বির সহোদর মাদক বিক্রেতা লাভলু নতুন একটি মাদক মামলায় কারাগারে আছে। তবে রাব্বি আত্মসমর্পন করেও মাদক ব্যবসা চালাচ্ছে, এটা অনেকটা সত্য।’

মাদক বিক্রেতারা পুলিশের সোর্স না বিষয়টি নিশ্চিত করে উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিশির কুমার পাল জানিয়েছেন, ‘মাদক ব্যবসায়ী রাব্বির ছোট ভাই লাভলুকে কয়েকদিন আগে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে লাভলুর বড় ভাই রাব্বি পুলিশের সোর্সের কাজ করে তথ্যটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন।’

ওসি আরও জানান, ‘তিনি ইতোমধ্যেই পৌর এলাকার চিহ্নিত নতুন ও পুরাতন মাদক ব্যবসায়ীদের কঠোরভাবে হুশিয়ার করেছেন। এছাড়া আগামী এক মাসের মধ্যে পৌর সদরে তিনি ৯০ শতাংশ মাদক নির্মূল করবেন বলে জানিয়েছেন।’

2 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন