২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

মিন্নিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৪১ পূর্বাহ্ণ, ২১ আগস্ট ২০১৯

বরগুনায় প্রকাশ্যে দিবালোকে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত শাহ নেওয়াজ রিফাত শরীফের স্ত্রী কারাবন্দি আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আগামী ২৮ আগস্ট এই রুলের ওপর শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।

এদিকে গত ১৯ জুলাই মিন্নির বিচারিক (১৬৪ ধারায়) জবানবন্দি দেওয়ার একদিন আগে ১৮ জুলাই বরগুনার পুলিশ সুপারের (এসপি) সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের লিখিত ব্যাখ্যা জানাতে এসপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে মামলার যাবতীয় নথি সম্বলিত সিডি (কেইস ডকেট) নিয়ে আগামী ২৮ আগস্ট হাইকোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিুজর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ মঙ্গলবার শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। মিন্নির পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এএম আমিনউদ্দিন, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ও মাক্কিয়া ফাতেমা ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী ও সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহানা পারভীন।

আজ শুনানিতে এএম আমিনউদ্দিন বলেন, মিন্নিসহ ৫ জন এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তাই এই পর্যায়ে মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্থ করার কোনো সুযোগ নেই। মিন্নি একজন ১৯ বছরের নারী। যেকোনো শর্তে জামিন চাচ্ছি। আদালত যে শর্ত দেবেন তাই মেনে নেওযা হবে। জামিন দিলে মিন্নি পালাবে না। সে তার পিতার জিম্মায় থাকবে।

জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে বলা হয়, এটা একটি স্পর্শকাতর মামলা। এরমধ্যে মিন্নিসহ ১৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরমধ্যে মিন্নিসহ ৫ জন আসামি অপরাধ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সকলেই বলেছে, এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মিন্নি। তাই তাকে জামিন দেওয়া ঠিক হবে না।

পুলিশের সংবাদ সম্মেলন নিয়ে আদালতের প্রশ্ন
মামলার তদন্ত পর্যায়ে আইন শৃংখলাবাহিনীর সংবাদ সম্মেলন করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, শুধুই এই মামলা (রিফাত শরিফ হত্যা) নয়, আরো অনেক মামলায়ই দেখি যে, মামলার তদন্ত পর্যায়ে আইন শৃংখলাবাহিনী সংবাদ সম্মেলন করে বলে যে আসামি দোষ স্বীকার করেছে। মামলার তদন্ত পর্যায়ে তাদের এ ধরণের বক্তব্য দেওয়া কতটুকু যুক্তিসংগত? এতে জনগণের মধ্যে কি ধারণার সৃষ্টি হয়? একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি বলেন যে আসামি দোষ স্বীকার করে তবে সংশ্লিষ্ট অধস্তন পুলিশের দায়িত্ব হয়ে যায় ১৬৪ ধারায় আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করার।

আদালত বলেন, এই মামলায় এসপি সাহেব সংবাদ সম্মেলন ডেকে কি করে বললেন যে মিন্নি দোষ স্বীকার করেছে? এসপি বলার পর তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব হয়ে যায় তা যথাযথভাবে প্রমান করার। এটা হলে মামলার তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। জনগণের মধ্যে বিরুপ ধারণার সৃষ্টি হয়। তাই এটা নিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে। এ জন্য একটি নীতিমালা থাকা দরকার।

আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ইদানীং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন (আইন শৃঙ্খলা বাহিনী) করে আসামীকেও হাজির করা হচ্ছে। এর আগে গাজীপুরের এক জঙ্গীর মামলার সময় আমরা (আদালত) বলেছিলাম, আসামিদের এভাবে মিডিয়ার সামনে হাজির করে বক্তব্য (সংবাদ সম্মেলন) না দিতে। কিন্তু এখনও দেখছি, আসামিদের জ্যাকেট পরিয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হচ্ছে। এ ধরণের দৃষ্টান্ত বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে কি না জানা নেই। এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার।

পুলিশ লাইনে নিয়ে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে আদালতের প্রশ্ন
আজ শুনানিতে আইনজীবী এএম আমিনউদ্দিন বলেন, মিন্নিকে সাক্ষী হিসেবে তার বক্তব্য জানতে পুলিশ তাকে ১৬ জুলাই সকাল পৌণে ১০টায় পুলিশ লাইনে ডেকে নিয়েছে। এরপর রাত ১০টায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ১৯ বছরের একটি মেয়েকে পুলিশ লাইনে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের পরিণতি কি হতে পারে তা সকলেই উপলব্ধি করতে পারে। তার উপর কতটা চাপ থাকে তা বোঝা যায়! এছাড়াও এ মামলার আরেক আসামিকে ১ জুলাই গ্রেপ্তারের পর ১৪ জুলাই জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে যার মধ্যে একটি বড় সময়ের ব্যবধান রয়েছে।

এসময় আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এমন হলে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু থাকে? কতটুকু সত্য বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকে?

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, মিন্নিকে অনেক পরে (মামলা হওয়ার) ডাকা হয়েছে। এর আগেই কয়েকজন আসামি স্বীকারেক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাতে মিন্নির সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসে।

এসময় আদালত বলেন, জিজ্ঞাসাবাদেরও তো একাট নিয়মনীতি রয়েছে। আদালতে উপস্থিত অপরাপর আইনজীবীদের দেখিয়ে বলেন, এখানে অনেকে আছেন যাদের একসময় ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে একজন লোককে নেওয়া হলে তার মানসিক অবস্থা কি হতে পারে? আদালত বলেন, ধরে নিলাম যে মিন্নির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি ঠিক আছে। তারপরও এটা কি যথাযথ প্রক্রিয়া?

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, মিন্নি তার স্বামীকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। এটা কেমন কথা যে স্বামীকে শিক্ষা দিতে হবে? তিনি বলেন, আগামী ২২ আগষ্ট এ মামলায় বিচারিক আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য্য রয়েছে। সেখানে সব উঠে আসবে।

মিন্নির জবানবন্দি হাইকোর্টে
শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মিন্নি ও অপর চার আসামির ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদালতকে দেখতে দেওয়া হয়। দুই বিচারপতি নিরবে আসামিদের জবানবন্দি পড়েন। এরমধ্যে মিন্নির জবানবন্দি পড়ার সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর কাছ থেকে একটি কপি নিয়ে মিন্নির আইনজীবী এএম আমিনউদ্দিনও পড়ে দেখেন। তিনি আদালতকে বলেন, জবানবন্দিতে কি আছে তা পড়বো না। তবে বলি, ১৬৪ ধারায় মিন্নির জবানবন্দি পড়লে বোঝা যায়, এটা সাজানো। একজন মানুষের কি এত ক্ষমতা যে, তিনি এত সুন্দর করে ঘটনার বর্ণনা দেবেন?

এর আগে গত ৮ আগস্ট বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের নেতৃত্বাধীন অবকাশকালীন বেঞ্চ জামিন দিতে রাজি না হওয়ায় আইনজীবী মিন্নির জামিনের আবেদন ফেরত নিয়েছিলেন। এ অবস্থায় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে জামিনের আবেদনটি শুনানির জন্য আজ উপস্থাপন করা হয়। মিন্নির আইনজীবী বলেন, মিন্নি একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। সে মামলার এক নম্বর সাক্ষী। অথচ তাকে গত ১৬ জুলাই পুলিশ লাইনে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেপ্তার করে। এর পরদিন ১৭ জুলাই তাকে আদালতে নিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এরপর তাকে আবার পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। আইনজীবী বলেন, মিনির পক্ষে যাতে কোনো আইনজীবী দাঁড়াতে না পারে সেজন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। একারণে মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াতে পারেনি।

গত ২৬ জুন সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাত শরীফকে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহত রিফাতের পিতা আব্দুল আলিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে মামলা করেন। এই মামলার মিন্নি, রিফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয়সহ ১৫ জনকে আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া এজাহারভুক্ত নয়ন বন্ড ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। গত ১৬ জুলাই রাতে মিন্নিকে গ্রেপ্তার করে পরদিন ১৭ জুলাই তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই গত ১৯ জুলাই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় মিন্নি। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগেরদিন ১৮ জুলাই দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন বরগুনার এসপি মারুফ হোসেন। এ অবস্থায় প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ও পরে জেলা জজ আদালতে মিন্নির জামিনের আবেদন করা হলেও ওই দুই আদালতে তার জামিনের আবেদন খারিজ হয়। এরপর হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করা হয়।

3 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন