২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

মৃত্যুঞ্জয়ী এক বীরযোদ্ধার নাম আবদুল মজিদ খান

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:০৩ অপরাহ্ণ, ১৬ এপ্রিল ২০২১

মৃত্যুঞ্জয়ী এক বীরযোদ্ধার নাম আবদুল মজিদ খান

✪ আরিফ আহমেদ মুন্না ➤  ১৯৭১ সালে গৌরবোজ্জ্বল মহান মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করতে যে কয়জন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা অসীম সাহসিকতা নিয়ে বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সফল অপারেশনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে আবদুল মজিদ খান ছিলেন অন্যতম। বাবুগঞ্জ ও বরিশাল অঞ্চলের একটি বৃহৎ মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যুদ্ধকালীন এই বেইজ কমান্ডার ও বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রয়াত জেলা কমান্ডার কিংবদন্তির বীরযোদ্ধা আলহাজ্ব আব্দুল মজিদ খান।

আমার বাবা মোঃ আনসার উদ্দিন আহমেদ এই মহান মানুষটির অধীনেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক এই আলোকিত মানুষটি আমার বাবাকে খুব স্নেহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বাবাকে তিনি আগলে রেখেছিলেন আপন সন্তানের মতোই। বাবাকে নিরাপদ রাখতে কখনো নিজের কাছে আবার কখনো বার্তাবাহকের দায়িত্ব দিয়ে দূরে পাঠিয়ে দিতেন। অসম্ভব মেধাশক্তি আর তীক্ষ্ণ ইন্দ্রিয়শক্তি ছিল তাঁর। বিপদ হওয়ার আগেই তিনি সেটা আঁচ করতে পারতেন। স্বাধীনতার মহান সূর্যসারথি আলহাজ্ব আব্দুল মজিদ খানের বীরত্বপূর্ণ অনেক গল্প আমি আমার বাবার মুখে শুনেছি। শুনেছি মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিক এই বীরের বিভিন্ন রণকৌশল আর যুদ্ধক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তগ্রহণের অসাধারণ সব দক্ষতার অজানা কাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আগে আমার বাবা সরকারি বাবুগঞ্জ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। এই স্কুল থেকেই মেট্রিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে পাস করায় পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে তাকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন বাবুগঞ্জ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্দুল গফুর মোল্লা। বরেণ্য শিক্ষাবিদ গফুর মোল্লা স্যারের অনুপ্রেরণা আর বেইজ কমান্ডার মজিদ খানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শিক্ষকতা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আমার বাবা আনসার উদ্দিন আহমেদ।

দেশ স্বাধীনের পরে আমার বাবাকে পুলিশের দারোগা পদে (সাব-ইন্সপেক্টর) চাকরি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তবে ঘুষ খেতে হয় বলে পুলিশের চাকরি পছন্দ করতেন না আমার দাদা। তাই দাদার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে বাবা আর সেই পুলিশের এসআই পদের চাকরিতে শেষ পর্যন্ত যোগদান করেননি। তিনি পুনরায় ফিরে যান শিক্ষকতা পেশায়। বাবা অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় কিছুদিন পরেই ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে সোনালী ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বাবা এবার কী করবেন সেই পরামর্শ নিতে দৌড়ে যান কাকা বলে সম্মোধন করা তার প্রিয় অভিভাবক মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার আলহাজ্ব আব্দুল মজিদ খানের কাছে। পরে তাঁর সম্মতি এবং পরামর্শেই মূলত আমার বাবা সোনালী ব্যাংকের অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। কর্মস্থলে যোগদানের জন্য বিদায় নিতে যাবার সময় আবদুল মজিদ খান আমার বাবাকে বলেছিলেন-“দেখ বাবা, যে অসৎ পয়সার জন্য তোর বাপ তোরে পুলিশের এতবড় ক্ষমতা আর সুযোগের লোভনীয় চাকরিতে যেতে দেয়নি সেই অসৎ টাকা-পয়সা জীবনে কখনো স্পর্শ করিস না।” আমার বাবা তার প্রিয় অভিভাবক কাকার সেই উপদেশটি দীর্ঘ ৫০ বছরে এক মুহূর্তের জন্যেও হয়তো ভোলেননি।

আমার বাবা নিজের সততা, মেধা ও দক্ষতায় পদোন্নতি পেয়ে শেষ পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার থেকে অডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর। সারা বাংলাদেশে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সকল শাখাই পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করেছেন তিনি। তার রিপোর্টে অনেক দুর্নীতিবাজ ম্যানেজার বরখাস্ত হয়েছেন, চাকরিচ্যুত হয়েছেন অনেকে। তবুও নিজে চাকরিজীবনে কখনো একটি হারাম পয়সা স্পর্শ করেননি। অডিটর হিসেবে ঘুষ খেলে বাবা অনায়াসে কোটি কোটি টাকা আয় করতে পারতেন। গুলশান-বনানীর মতো জায়গায় বহুতল ভবনের মালিক হতে পারতেন। মার্সিডিজ কিংবা বিএমডব্লিউর মতো দামি গাড়ি থাকতো। অথচ তিনি এখনো পায়ে হেঁটেই চলাচল করেন। খুব দূরের পথ না হলে এখনো পাবলিক গাড়িতেও চড়েন না তিনি।

সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার থেকে আমার বাবা যখন অবসরগ্রহণ করেন তখন পেনশনের টাকা পাওয়ার আগে তার একমাত্র ব্যাংক একাউন্টে জমা ছিল মাত্র ১৩৮৭ টাকা। এটা আমার সীমাহীন গর্ব যে, আমার পিতা কখনো ঘুষ-দুর্নীতি-অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও একটি টাকার সুযোগ নেননি কখনো। এমনকি সরকারি চাকরি করার কারণে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়ে কখনো কোনো ধরনের ভাতা পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। ভাতার প্রসঙ্গ আসলে সবসময় তাকে বলতে শুনেছি-“ভাতা নিতে যাবো কেন? আমি অসচ্ছল নাকি যে ভাতা নেবো? মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সরকার চালু করেছিল অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। আমি দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি। মুক্তিযোদ্ধা নাম ফুটানো কিংবা দেশ থেকে বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য যুদ্ধ করিনি।”

আমার বাবা সারাজীবন এই চেতনাই লালন করেছেন। কেউ তার নিজস্ব ভাবনা থেকে কখনো তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। চাকরিকালীন সময়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য কখনো আবেদন পর্যন্ত করেননি। নিজের স্বার্থত্যাগ করার এই অবিনাশী চেতনা হয়তো বাবা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে থেকে। এই সততা তিনি হয়তো শিখেছিলেন তার শিক্ষাগুরু আব্দুল গফুর মোল্লা স্যারের কাছ থেকে। এই নির্মোহ নীতি-আদর্শ তিনি হয়তো অর্জন করেছিলেন তার অভিভাবক এবং কমান্ডার আব্দুল মজিদ খানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকেই। আমি গর্বিত এমন পিতার সন্তান হতে পেরে এবং সেই পিতার আদর্শিক অভিভাবকের জন্য দুকলম লিখতে পেরে।

 

গত ১৪ এপ্রিল ছিল আমার পিতার সেই আদর্শিক অভিভাবক, পরামর্শক ও পথপ্রদর্শক আলহাজ্ব আব্দুল মজিদ খানের মৃত্যুবার্ষিকী। যিনি বাংলার মাটিকে একদা শত্রুমুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি, বরং নতুন প্রজন্মকে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা উপহার দিতে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। ২০১০ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন বাবুগঞ্জ উপজেলার কিংবদন্তির বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমাজ সংস্কারক, আদর্শিক রাজনীতিবিদ ও আইকনিক নেতা আলহাজ্ব আব্দুল মজিদ খান। বিপ্লবী এই বীরযোদ্ধাকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম ও অভিবাদন। যতদিন এই প্রিয় মাতৃভূমি বেঁচে থাকবে, স্বাধীনতার লাল-সবুজ পতাকা বাতাসে উড়বে ততদিন তাঁর গৌরবময় বীরত্বকাব্য উচ্চারিত হবে। যুগে যুগে তাঁর অনন্ত দেশপ্রেমের মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনা ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

লেখকঃ আরিফ আহমেদ মুন্না
(সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও মানবাধিকার কর্মী)
প্রতিবেদক, দৈনিক সমকাল ও দি নিউ নেশন।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বিমানবন্দর প্রেসক্লাব।
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, বরিশাল বিভাগীয় কমিটি।
উপজেলা সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
আহবায়ক, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ, বাবুগঞ্জ উপজেলা কমিটি।

14 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন