১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কিংবদন্তির শিক্ষাগুরু মানিক স্যার

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৫০ পূর্বাহ্ণ, ০৭ জুন ২০২০

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কিংবদন্তির শিক্ষাগুরু মানিক স্যার

আরিফ আহমেদ মুন্না বাবুগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের আহবায়ক, দুই প্রজন্মের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ শাহজাহান মানিক (৮১)। শুক্রবার বিকেলে বাদ আছর উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভূতেরদিয়া গ্রামের আছিয়া ওয়াজেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে বাবুগঞ্জ থানা পুলিশের একটি চৌকস দল তাকে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র সালাম ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। এসময় উপজেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকার পরে শুক্রবার ভোর ৭টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাবুগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানিক স্যার নামে পরিচিত এই কিংবদন্তির শিক্ষাগুরু।

বাবুগঞ্জ উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভূতেরদিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন শাহজাহান মানিক। তৎকালীন বাবুগঞ্জ বহুমুখী হাইস্কুল (বর্তমান সরকারি বাবুগঞ্জ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়) থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ (বর্তমান সরকারি বি.এম কলেজ) থেকে বাণিজ্য বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে বাবুগঞ্জ বহুমুখী হাইস্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে যোগাযোগ করেন তিনি। মেট্রিক পাস করা নিজের স্কুলেই আবার ক্রীড়া শিক্ষক হওয়ার মাধ্যমে ঐতিহাসিক শিক্ষকতা জীবনের সূচনা করেন শাহজাহান মানিক।

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি তৎকালীন বেইজ কমান্ডার আবদুল মজিদ খান ও সহকারী বেইজ কমান্ডার আবুল কাশেমের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে আবার ফিরে আসেন তৎকালীন বাবুগঞ্জ বহুমুখী হাইস্কুলের পুরোনো শিক্ষকতা পেশায়। প্রায় ৫০ বছরের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি বেশ কয়েকটি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাবুগঞ্জ উপজেলার শিক্ষাবিস্তারে অসামান্য অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতার পরে কিছুকাল বাবুগঞ্জ বহুমুখী হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার পরে তৎকালীন রহমতপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও সমাজসেবক মোতাহার আলী হাওলাদার নিজেদের পৈত্রিক জমিতে খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রধান শিক্ষক হিসেবে সেই স্কুলের দায়িত্ব তুলে দেন শাহজাহান মানিকের কাঁধে।

আশির দশকে টিনের ছাপড়া দেওয়া সেই খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (বর্তমানে রাশেদ খান মেনন মডেল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়) দায়িত্বভার গ্রহণ করে নিজের কর্মদক্ষতায় আক্ষরিক অর্থেই একটি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন শাহজাহান মানিক। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জীর্ণশীর্ণ টিন ও চাটাইয়ের বেড়া দেওয়া স্কুলটিতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। একপর্যায়ে এমপি রাশেদ খান মেননের সহায়তায় তৎকালীন যশোর বোর্ড থেকে তদবির করে সেই খানপুর স্কুলেই বাবুগঞ্জ উপজেলার মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার (এসএসসি) কেন্দ্র এনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক হিসেবে খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে টিনের ছাপড়া থেকে আজকের প্রতিষ্ঠিত বহুতল রাশেদ খান মেনন মডেল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরের নেপথ্যে শাহজাহান মানিকের অসামান্য অবদান রয়েছে। এছাড়াও তিনি নিজের পৈত্রিক গ্রামের বাড়ি কেদারপুর ইউনিয়নে সোনার বাংলা হাইস্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে কেদারপুরে সোনার বাংলা হাইস্কুলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সোনার বাংলা হাইস্কুলটি পরবর্তীতে কলেজ শাখায় উন্নীত হয়। স্কুল শাখায় প্রধান শিক্ষক থাকার পাশাপাশি তিনি কলেজ শাখার অধ্যক্ষ হিসেবেও কয়েকবছর দায়িত্ব পালন করেন। নিজের প্রতিষ্ঠিত সোনার বাংলা হাইস্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ থেকেই অর্ধশতাব্দীর বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা পেশাজীবনের সফল অধ্যায়ের সমাপ্তি টানেন তিনি।

সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতা করা ছাড়াও একজন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে বাবুগঞ্জ উপজেলার ক্রীড়া বিস্তারে শাহজাহান মানিকের অসামান্য অবদান রয়েছে। দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উপজেলার ক্রীড়াঙ্গনের একক নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ছাত্রজীবনে নিজেও নামকরা একজন ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। এছাড়াও ভলিবল এবং কাবাডি ভালো খেলতেন তিনি। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর তিনি বাবুগঞ্জ উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক এবং পরবর্তীতে আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের উপজেলা আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই কর্মবীর।

বাবুগঞ্জ উপজেলার দুই প্রজন্মের একজন শিক্ষাগুরু হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শাহজাহান মানিক মৃত্যুর আগে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের বেশি শিক্ষকতা পেশায় জড়িত থাকার কারণে তিনি বহু পিতার শিক্ষক ছিলেন। আবার পরবর্তীতে তাদের সন্তানদেরও শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছেন। জীবনে সততা, নীতি-আদর্শ ও কর্মদক্ষতার কারণে তিনি সবার কাছে প্রিয় মানিক স্যার নামে পরিচিতি লাভ করেন এবং কিংবদন্তিতুল্য হয়ে ওঠেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহবায়ক হিসেবেও দুইবার দায়িত্ব পালন করেছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

বাবুগঞ্জ বহুমুখী হাইস্কুলে ক্রীড়া শিক্ষক থাকাকালে তিনি পাকিস্তান পার্লামেন্টের হিজলা-মুলাদী আসনের সাবেক গণপরিষদের সদস্য (এমএনএ) আবদুল জলিল খানের মেয়ে নূরুন্নাহার সুরাইয়া বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণের পরে সেখানে ছাত্রছাত্রীর চাপ বাড়লে নিজের স্ত্রীকে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করান তিনি। পারিবারিক জীবনে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক ছিলেন। নায়কের মতোই সুদর্শন এবং মনের দিক থেকে চিরতরুণ মানিক স্যার দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসের সঙ্গে লড়াই করে টিকেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে কিছুদিন আগে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যান। সেই থেকেই বেশি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। শুক্রবার ভোর ৭টার দিকে অনেকটা নিভৃতেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই কিংবদন্তির শিক্ষাগুরু। #

6 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন