২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

রিফাত হত্যা: নয়ন বন্ডের বন্ধু ও কাজের বুয়ার চাঞ্চল্যকর বর্ণনা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:২৪ পূর্বাহ্ণ, ২৮ জানুয়ারি ২০২০

বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় দায়রা আদালতে আজ সোমবার তিনজনের সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। এ সাক্ষীরা হলেন, মো. হেলাল সিকদার, মো. দুলাল খানঁ ও নয়ন বন্ডের বাসার কাজের বুয়া মোসা. ফুলি বেগম।

গতকাল সোমবার বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান তাদের সাক্ষ্য ও জেরা রেকর্ড করেন। এ ছাড়া শিশু আদালতেও দুজন সাক্ষ্য দিয়েছে। জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ পর্যন্ত ২৫ জন ও শিশু আদালতে নয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।

গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় বরগুনা জেলা কারাগার থেকে পুলিশ পাহারায় আটজন প্রাপ্তবয়স্ক আসামিকে দায়রা আদালতে উপস্থিত করা হয়। জামিনে থাকা আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিও আদালতে উপস্থিত হন। রিফাত হত্যায় আসামি মুছা পলাতক রয়েছে। সকাল সাড়ে ৯টায় আদালত এজলাসে বসেন জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান।

আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া শেষে হেলাল সিকদার বলেন, ‘নয়ন বন্ড আর আমি ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত বরগুনা জেলা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। এরপর একসঙ্গে কম্পিউটার শিখেছি। নয়ন বন্ড আমার ভালো বন্ধু। নয়ন বন্ড ২০১৮ সালের শেষ দিকে মিন্নিকে বিয়ে করে। ২০১৯ সালে বরগুনা ইউটিডিসি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের পূর্ব পাশে নয়ন বন্ড জম্মদিন পালন করে। আমি ওই অনুষ্ঠানে ছিলাম। মিন্নি একটি ফুলের তোড়া নিয়ে সেখানে আসে। রিফাত ফরাজি, তানভির, নাঈমসহ ১০-১৫ জন সেখানে উপস্থিত ছিল। মিন্নি নয়ন বন্ডকে কেক খাইয়ে দেয়। সে দৃশ্য আমি মোবাইল ফোনে ধারণ করে ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দেই।’

হেলাল সিকদার বলেন, ‘ঘটনার দুইদিন আগে রিফাত শরীফের সঙ্গে সকাল ১০টার সময় মিষ্টি পট্টির রোডে দেখা হয়। রিফাত আমাকে বলে, ‘‘তোর সঙ্গে কথা আছে। দেখা করিস।’’ ওইদিন বরগুনা প্রেসক্লাবের সামনে আবার দেখা হয়। আমাকে রিফাত শরীফ তার মোটরসাইকেলে করে জেলা স্কুলে নিয়ে যায়। রিফাত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই ভিডিও ছাড়ছোস কেন।” এরপর রিফাত আমার ফোন নিয়ে যায়।’

নয়ন বন্ডের বন্ধু আরও বলেন, ‘আমি এ ঘটনা নয়ন বন্ডকে বলে দেই। নয়ন বন্ড মিন্নিকে ফোন করে বলে, রিফাত শরীফ যেন আমার ফোনটি দিয়ে দেয়। মিন্নি রিফাত শরীফকে আমার ফোন দিতে বলে। এতে রিফাত শরীফ ক্ষিপ্ত হয়ে মিন্নিকে চড়-থাপ্পড় দেয়। আমি শুনেছি এতে মিন্নি ক্ষুধ্ব হয়।’

রিকশাওয়ালা দুলাল খাঁন বলেন, ‘ঘটনার দিন ২৬ জুন সকাল ১০টায় একজন যাত্রী নিয়ে আমি ঘটনাস্থল ক্যালিক্স একাডেমির সামনে যাই। যাত্রী নামিয়ে দিয়ে আবার যাত্রীর অপেক্ষায় থাকি। তখন দেখি ৭-৮ জন পোলাপান একটি ছেলেকে টানাহেঁচরা ও কিল-ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে আসে। একটু পর দুই ছেলে দুটি দা নিয়ে এসে ওই ছেলেটাকে কোপাতে থাকে। ছেলেটি রক্তাক্ত অবস্থায় আমার রিকশায় উঠে বলে, ‘‘আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।’’ আমি একটু দূরে আসার পরে একটি মেয়ে এসে আমার রিকশায় ওঠে। আমি মেয়েটিকে ছেলেটার কাটা জায়গা চেপে ধরতে বলি। রক্তে আমার রিকশা ভিজে যায়। পুরো রোডে রক্ত পড়েছে। আমি আহত ছেলেটিকে বরগুনা হাসপাতালে নিয়ে আসি। সঙ্গে ওই মেয়েটাও ছিল। পরে জানতে পারি নয়ন বন্ড, রিফাত ফারাজি, রিশান ফরাজিরা রিফাত শরীফকে কুপিয়েছে।’

নয়ন বন্ডের বাসার কাজের মহিলা মোসা. ফুলি বেগম বলেন, ‘আমি প্রায় দুই বছর নয়ন বন্ডের বাসায় কাজ করি। তারিখ মনে নেই। তবে দেড় বছর আগে নয়ন বন্ড আর মিন্নির বিয়ে হয়। মিন্নি নয়ন বন্ডের বাসায় বসে। ওই সময় আমি ছিলাম। নয়নের মা সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। আমিও মিষ্টি খাই। পরে দিন নয়ন বন্ড আর মিন্নি কুয়াকাটা যায়। এক সপ্তাহ কুয়াকাটা থাকার পর আাবার বাসায় আসে। মিন্নি প্রতিদিন নয়ন বন্ডের বাসায় আসতো, রাতও থাকত।’

ফুলি বেগম বলেন, ‘মিন্নির মা নয়ন বন্ডের মাকে ফোন করে বলত, বেহাইন আমার মেয়েকে গরম পানি করে দিবেন। ও ঠাণ্ডা লাগাতে পারে না।’

ফুলি বেগম আরও বলেন, ‘রিফাত শরীফ মারা গেছে বুধবার। আগের দিন মঙ্গলবার সকাল অনুমান ১০টার সময় মিন্নি নয়ন বন্ডের বাসায় আসে। আমি দরজা খুলে দেই। নয়ন বন্ড তখন ঘুমে ছিল। মিন্নি নয়ন বন্ডের রুমের দরজায় টোকা দেয়। নয়ন বন্ড দরজা খুলে দিলে মিন্নি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। অনুমান দেড় ঘণ্টা থাকার পর মিন্নি চলে যায়। এমনিভাবে মিন্নি প্রত্যেকদিন নয়ন বন্ডের বাসায় আসত। মিন্নির স্যালোয়ার-কামিজ নয়নদের বাসায় থাকত। রাতেও মিন্নি নয়নের বাসায় থেকেছে। নয়নের মা জানত না মিন্নিকে রিফাত শরীফ বিয়ে করেছে। আমিও জানতাম না। রিফাত শরীফ খুন হওয়ার পর শুনি মিন্নি আবার বিয়ে বইছে।’

আসামি পক্ষের সাতজন আইনজীবী তিনজন সাক্ষীদের জেরা করেন।

আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালতে যেভাবে সাক্ষ্য দিয়েছে, তাতে আসামিরা ন্যায়বিচার পাবেন।’ অন্য আসামিদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা সাক্ষীদের জেরা করেনি।

রাষ্ট্রপক্ষের পিপি ভুবন চন্দ্র হাওলাদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘যারা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা সকলেই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রপক্ষ আশা করে, বাদী ন্যায়বিচার পাবেন। মিন্নি রিফাত শরীফের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তা নয়ন বন্ডের বাসার কাজের মহিলা সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

শিশু আদালতে ১৪ আসামী বিরুদ্ধে দুইজন সাক্ষ্য প্রদান :

বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় শিশু আদালতে আজ দুজনের সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। ওই আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মঞ্জুরুল আলম জন ও আনোয়ার হোসেন মৃধা। শিশু আদালতের বিচারক মো. হাফিজুর রহমান তাদের সাক্ষ্য রেকর্ড করেন। তাদেরকে ১০জন আইনজীবী জেরা করেন।

সোমবার সকালে কারাগার থেকে শিশু আসামি ৯ জন ও জামিনে থাকা ৫ জন আসামি আদালতে উপস্থিত হয়।

শিশু আদালতে সাক্ষ্য শেষে মঞ্জুরুল আলম জন বলেন, ‘ঘটনার দিন ২৬ জুন সকাল অনুমান ১০-২০ মিনিটের সময় আমি মনিরের ফোন পাই যে, নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজি, রিশান ফরাজি, টিকটক হৃদয়সহ আরও ১০-১৫ জন লোক রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম করেছে। আমি বরগুনা হাসপাতালে যাই। ওই সময় রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ, চাচা আবদুল আজিজ শরীফ ও সালাম শরীফ হাসপাতালে আসে। রিফাত শরীফকে রক্তাক্ত অবস্থায় বরিশাল হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমিও একটি গাড়ি নিয়ে বরিশাল যাই। ওখানে রিফাত মারা যায়। আমি রিফাতের সুরতহাল রিপোর্টে স্বাক্ষর করি। রিফাতের পরনে জিন্সের প্যান্ট আমার সামনে জব্দ করে পুলিশ। আমি আদালতে রক্তমাখা জিন্সের প্যান্ট শনাক্ত করেছি।’

সাক্ষ্য আনোয়ার হোসেন মৃধাও একই সাক্ষ্য দেন। আসামি নাজমুল হাসানের পক্ষের আইনজীবী মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ওই দুজন সাক্ষীর কেউ রিফাত শরীফকে কোপাতে দেখেনি। সবই শোনা সাক্ষ্য। শোনা সাক্ষ্যের কোনো মূল্য নেই।’

রাষ্ট্রপক্ষে বিশেষ পিপি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল বলেন, ‘সাক্ষীরা যেভাবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাতে সকল আসামিদের সাজা হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া আটজন আসামি ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আমি আশা করি, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য দিয়ে মামলা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে।’

0 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন