১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

শাহজালালে এখনো নিরাপত্তাঝুঁকি

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

বার্তা পরিবেশক, অনলাইন::: বাংলাদেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন বা কেপিআই নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। ২০১৩ সালে এ নীতিমালা হালনাগাদ করা হয়। কেপিআইভুক্ত স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে- হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দেশের প্রধানতম এ বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে সমপ্রতিরক্ষা সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তি নষ্ট হবে- এমনকি জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যন্ত মারাত্মক আঘাত আসবে।

অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি, খোদ রাজধানীতে অবস্থিত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থাপনাকে এ পর্যন্ত নিরাপত্তাঝুঁকি থেকে মুক্ত করা যায়নি বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও। ফলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা, যা দেশের জন্য অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিতে পারে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বিমানবন্দরটির আশপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে বহুতল অনেক ভবন; এখনো অনেক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু সুউচ্চ এসব বাণিজ্যিক ভবন বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে স্পষ্টতই ঝুঁকিপূর্ণ।

এসব ভবনের ছাদ থেকে যে কোনো সময় সাবোটাজ হতে পারে। এসব বিষয়ে সতর্ক করে ইতিপূর্বে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল কেপিআই সার্ভে টিমের তরফে। কিন্তু সেসব সুপারিশের অধিকাংশই কাগুজে রয়ে গেছে, কার্যকর হয়নি। কেপিআই সার্ভে টিম নিরাপত্তাঝুঁকির নানা দিক তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরে এ থেকে উত্তরণে বেশ কিছু সুপারিশও করেছিল।

এদিকে অতিসম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ফের উঠে এসেছে শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়টি। বন্দরটির বাইরেই শুধু নয়, ভেতরের অনেক অব্যবস্থাপনাও তুলে ধরা হয়েছে সর্বশেষ এ প্রতিবেদনে, চিহ্নিত করা হয়েছে বেশ কিছু সমস্যা-সংকট। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ৭টি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে তাদের এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল, পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী সাংবাদিকদের জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সার্বিক অবস্থার বিষয়ে কেপিআই সার্ভে টিমের জরিপ প্রতিবেদন পেয়েছি। প্রতিবেদন দেখে মনে হয়েছে কঠোর সার্জারি প্রয়োজন। অচিরেই এ সার্জারির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

এ ছাড়া প্রতিবেদনে নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে যেসব বিষয় সামনে এসেছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের বেশ কিছু দোকানপাট অপসারণও করা হয়েছে। থার্ড টার্মিনাল স্থাপিত হলে সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করা হবে না বলেও উল্লেখ করেন প্রতিমন্ত্রী।

কেপিআই সার্ভে টিমের জরিপের বরাত দিয়ে বিমানবন্দর সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের সামনে কেপিআই আওতাধীন জমি ব্যবহার করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কেপিআইডিসির অনুমতি ছাড়াই বেসরকারিভাবে ইপকো প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের শপিংমল। হ্যাঙ্গার গেটে প্রবেশ পথে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতলবিশিষ্ট অফিস ভবন।

ভবনগুলোর ছাদ থেকে কেপিআইয়ের স্পর্শকাতর এলাকাসহ সব কিছুই দৃশ্যমান। এ ছাড়া বিমান অবতরণ ও উড্ডয়ন স্থান বরাবর স্থাপনার উত্তর ও পশ্চিম পার্শ্বস্থ ২০ মিটারের মধ্যে সীমানা দেয়ালের বাইরে বেড়িবাঁধের ওপর এখনো অব্যাহত আছে গাড়ি চলাচল ও লোকজনের যাতায়াত। এ এলাকায় এপিবিএন ও আনসার সদস্যদের নজরদারিও অপ্রতুল।

নিয়মানুযায়ী বিমানবন্দরের সীমানার বাইরেও ২০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত বৈধ-অবৈধ স্থাপনার বিবরণ এবং ভবনগুলোয় বসবাসরত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিতে হবে কেপিআইডিসি সভাপতির কাছ থেকে। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরের সীমানার পশ্চিম পাশে ২০ মিটারের মধ্যেই ৮টি ভবন এবং উত্তর পাশে ১০টি ভবন গড়ে উঠেছে। তাদের কারোই নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেই। আশপাশের শপিংমল এবং বহুতলবিশিষ্ট অফিস ও ভবনে বসবাসরতদের অবস্থাও তাই।

এ ছাড়া বিমানবন্দরটির আরও ৫৫টি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয় জরিপ দলের প্রতিবেদনে। কেপিআই সার্ভে টিম তাদের প্রতিবেদনের অভিমত ও সুপারিশ অধ্যায়ে উল্লেখ করেন, কেপিআইয়ের যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। নিরাপত্তা বিধানে কোনো ধরনের শিথিলতা থাকলে তা নাশকতাকারী ও দুষ্কৃতকারীদের সহজ টার্গেটে পরিণত হয়।

বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে ২০টি সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার ও পার্শ্ববর্তী কার্গো ভিলেজ আমদানি-রপ্তানি শাখার বিভিন্ন মালামাল ১১ নম্বর বোর্ডিং ব্রিজসংলগ্ন পার্কিং এলাকার আশপাশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় আছে। ফলে যে কোনো সময় অগ্নিদুর্ঘটনাসহ বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। কার্গো ভিলেজ আমদানি ও রপ্তানি এলাকায় নেই পর্যাপ্ত ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট (অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র)। আগে ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট স্থাপনের জন্য সুপারিশ করা হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বিমানবন্দরে প্রবেশকারী যানবাহন তল্লাশির ক্ষেত্রে বন্দরের মূল প্রবেশপথগুলোয়, বিশেষ করে গোলচত্ত্বর, ভিআইপি টার্মিনালের অ্যাপ্রোচ রোড, পদ্মা অয়েল ডিপো লিঙ্ক রোড ও বেবিচকের প্রধান কার্যালয়ের সামনের অ্যাপ্রোচ রোডে নিরাপত্তার স্বার্থে অত্যাধুনিক আন্ডার ভিইকল সার্চ ক্যামেরা স্থায়ীভাবে স্থাপন করতে হবে। বাউনিয়াস্থ রানওয়ে ১৪ অ্যাপ্রোচ এলাকায় বিমান ওঠানামার দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই উৎসুক জনতার ভিড় জমে। প্রায় রাতেই কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষ বিমানের ককপিটে লেজার লাইট তাক করে; উত্যক্ত করে পাইলটদের। নীলনকশার মাধ্যমে এসব স্থান থেকে অনেক বড় অপতৎপরতা বা নাশকতা কিংবা জঙ্গিবাদ উস্কে দেওয়া অপকর্ম চালানোও অসম্ভব নয়। বাউনিয়া বেড়িবাধের উপর দিয়ে লোকজনের যাতায়াত অনতিবিলম্বে বন্ধ করে দিয়ে তাদের জন্য পৃথক আন্ডারপাস/টানেল নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর কেপিআইডিসির সভায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সাত বছর পরও সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।

শাহজালাল বিমানবন্দর ১২৯৮ একর জমির উপর অবস্থিত। এ বিশাল এলাকায় ফ্লাডলাইট মাত্র ৫৭টি। যা অপর্যাপ্তই বটে। আর অপর্যাপ্ত আলো না থাকাও নিরাপত্তার জন্য এক ধরনের হুমকি। বিমানবন্দরে স্থাপিত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাগুলো দিয়ে রাতের আধারে টার্মিনাল ভবন ছাড়া অন্যান্য সকলস্থানে বিশেষ করে ভিআইপি লাউঞ্জ, পার্কিং-বে, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে এবং বোর্ডিং ব্রীজগুলোর প্রায় কোনও কিছুই অবলোকন করা সম্ভব হয় না। এগুলোও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

সুপারিশে আরও বলা হয়- বিমানবন্দরে নিয়োগকৃত জনবলের পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে কি না- খোদ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর এলাকায় কর্মরতদেরও ভেটিং সম্পন্ন হয়নি। এসব এলাকায় কর্মরতদের নিয়মিতভাবে ভেটিংসহ স্থাপনার ক্লিয়ারেন্সের জন্য একে ট্রেডার্স কর্তৃক ৩০০জন, অ্যাপ্রোন এলাকার জন্য ক্রাউন প্রপার্টিজ লিমিটেড কর্তৃক ৩৫ জন, দর্শণার্থী প্রবেশ গেটে শফিক অ্যান্ড ব্রাদার্স কর্তৃক ৩৬জন কর্র্মীর জরুরী ভিত্তিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন ও ভেটিং এবং নাম ঠিকানা ছবিসহ সংরক্ষণ করতে সুপারিশ করা হয়েছে। বিমানবন্দর কনকর্স হল এবং ইমিগ্রেশনের অভ্যন্তরে ১৬টি খাবারের দোকান আছে। কনকর্স হলের পূর্বপাশে ২টি বড় খাবারের দোকান রয়েছে। কনকর্স হলে লাগেজ প্যাকিং এবং হেল্প লাইনের নামে ৪টি নতুন দোকান ও সেন্টার গড়ে উঠেছে। যার ফলে এসব দোকানে কাজ করার জন্য প্রতিদিন বহু বহিরাগত বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। এসব লোকের অবাধ যাতায়াত বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সব মিলিয়ে খুবই নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে আমাদের দেশের সার্বিক অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ এ স্থাপনাটি।

1 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন