২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

শিশু অপহরণকারী গলাচিপার লুপার যত কু-কীর্তি…

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৫:১২ অপরাহ্ণ, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

আহমেদ জালাল >> ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এলাকা থেকে ফুল বিক্রেতা জিনিয়াকে(৯)ফুচকা খাইয়ে ও ঘোরাঘুরি করিয়ে অপহরণের হোতা নূর নাজমা ওরফে লুপা তালুকদার(৪২)কে গ্রেপ্তারের পর ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। বেড়িয়ে আসছে লুপা ও তার পরিবারের দীর্ঘ কালো অধ্যায়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য। মুখ খুলতে শুরু করেছেন এলাকার আতঙ্কিত হয়রানির শিকার ভুক্তভোগীসহ নানা শ্রেনী পেশার মানুষ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশবিরোধী শিবিরে অবস্থান করে পাকিস্তানী হানাদারদের দোষর বনে যান তার  বাবা প্রয়াত হাবিবুর রহমান ওরফে নান্না মিয়া তালুকদার। পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলায় এই পরিবারটি রাজাকার পরিবার হিসেবে পরিচিত থাকলেও সব আমলে দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেছেন। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষেরা যেনো এক ভয়ার্ত পরিবেশে চরম ভয়ের মধ্যে থাকতেন। তাদের ভাষ্য-নিরবে ক্ষোভ প্রকাশ করা ব্যাতীত পন্থাই বা কি ছিলো? যেখানে সব সরকারের আমলেই শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্বের প্রভাবশালী একটি অংশকে কৌশলীভাবে ম্যানেজ প্রক্রিয়ায় রাজাকার নান্না মিয়া পরিবারের পক্ষে রাখতো।

অনুসন্ধানে জানা গেছে-পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গোলখালী তালুকদার বাড়ির প্রয়াত হাবিবুর রহমান ওরফে নান্না মিয়া তালুকদারের কণ্যা নূর নাজমা ওরফে লুপা তালুকদার। অবশ্য গ্রামের বাড়ি তাদের পরিবারের কেউ থাকতো না। গলাচিপা পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের আওতাধীন থানা লাগোয়া বাড়িতেই থাকেন নান্না মিয়ার পরিবার। এই নূর নাজমা ওরফে লুপা তালুকদারের বিরুদ্ধে পটুয়াখালী ও গলাচিপায় রয়েছে এন্তার অভিযোগ। বিশেষ করে গলাচিপায় এক সময়ে ছিলো মূর্তিমান আতঙ্কের নাম লুপা তালুকদার। নানাবিধ কর্মকাণ্ডে ঢের সমালোচনার জন্ম দেন নিজ এলাকা গলাচিপায়। বহুল বিতর্কিত লুপা গলাচিপায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ হত্যাযঞ্জের হোলিখেলায় মত্ত ছিলো। গলাচিপায় স্পর্শকাতর ট্রিপল মার্ডারে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে লুপার বিরুদ্ধে। তার ক্ষমতার হাত ছিল অনেক লম্বা। তার তার ইশারায় অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ হতো। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল তার।

অনুসন্ধানী সূত্রগুলো জানায়-গলাচিপায় লুপার বাসায় শাহিনুর নামে এক নারী গৃহকর্মীর কাজ করতেন। লুপার পরিবারের কয়েকজন ওই গৃহকর্মী’র ওপর ধারাবাহিকভাবে যৌন নির্যাতন চালাত। পরবর্তীতে গৃহকর্মী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার বিষয়টি এলাকায় ফাঁস হওয়ায় বিপাকে পড়ে লুপার পরিবার। ছক করেন অন্তঃসত্ত্বা গৃহকর্মী ও তার শিশু কণ্যাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার। এরপর লুপার পরিকল্পনায় তার পরিবারের সদস্যরা মিলে অন্তসত্বা শাহিনুর ও তার শিশুকন্যাকে অপহরণ করে ট্রলারে তুলে শ্বাসরোধে হত্যার পর বস্তাবন্দি করে নদীতে ফেলে দেয়। এ বিষয়ে ২০০৩ সালে পটুয়াখালীর গলাচিপা থানায় লুপা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনার তদন্তে লুপা, তার বাবা প্রয়াত হাবিবুর রহমান ওরফে নান্না মিয়া তালুকদার, তার দুই ভাই প্রয়াত মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে লিটন তালুকদার, মোস্তাইনুর রহমান ওরফে লিকন তালুকদার, লুপার স্বামী রফিকুল ইসলাম বাদল ওরফে শহীদ বাদল, সুজন, হাকিম আলী, সেরাজ মিয়া, আলী হোসেন, ইছাহাক আলী ওরফে ইছছেক আলীসহ বেশ কয়েকজনের সম্পৃক্ততার তথ্যপ্রমাণ পেয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০১৩ সালে ওই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি লুপা ও তার স্বজনরা ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ রেহাই পান। রাজাকার পরিবারের মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহারের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধাসহ সচেতনমহল। তারা নিরবে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন।

বলছেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে লুপার বাবা হাবিবুর রহমান ওরফে নান্না মিয়া তালুকদারসহ পরিবারের আরও দুই সদস্য শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মামলা ও অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টিকে আওয়ামী পরিবারের সদস্য হিসেবে ‘রাজনৈতিক হয়রানি’ দাবি করে তাদের রেহাই পেতে শুপারিশ করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি হারুন অর রশীদও শুপারিশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন অধিশাখা-১-এর উপসচিব মো. মিজানুর রহমান গলাচিপা থানার ওই মামলার (মামলা নং-১ তারিখ (১/৬/০৩) ধারা ৩৬৪/৩০২/২০১/৩৪ দণ্ডবিধি) আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে লিটন, মোস্তাইনুর রহমান ওরফে লিকন, হাকিম আলী, আলী হোসেন ও লুপার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন না চালানোর সিদ্ধান্তের কথা পটুয়াখালী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়ে দেন। এ ঘটনায় সহযোগী একাধিক আসামির সাজা হলেও লুপা ও তার স্বজনরা এ মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘নান্না তালুকদার চিহ্নিত রাজাকার ও লুটেরা ছিলেন। তবে ভুলবশত তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী লীগের নেকাকর্মী হিসেবে প্রত্যয়ন করা হয়েছিল। আমার সেক্রেটারি গোলাম মোস্তফা টিটুর তথ্যের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পটুয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার ও জয় বাংলা মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘গলাচিপার নান্না তালুকদারসহ ওই পরিবারের তিনজন চিহ্নিত রাজাকার রয়েছেন। যারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি ও সম্পদ লুট করেছে। রাজাকারের তালিকায় তাদের সবার নাম আছে।’

৭ সেপ্টেম্বর সোমবার রাত ১টা দশ মিনিটে মিনিটে নারায়নগঞ্জ জেলা ফতুল্লা থানার আমতলা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ভিকটিম জিনিয়াকে উদ্ধারসহ অপহরণকারী লোপা তালুকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় অপহরণ মামলা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। ডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাংবাদিক পরিচয়ে লুপা বেগম নানা ধরণের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত। তবে জিনিয়া অপহরণের নেপথ্য কাহিনী উদঘাটনই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। এজন্যই তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ডিবির রমনা জোনাল টিমের উপকমিশনার আজিমুল হক বলেন, ‘অপহরণকারী নারীকে গ্রেপ্তারকালে তার হেফাজত থাকা শিশু জিনিয়াকে উদ্ধার করা হয়। পরে দুজনকেই কোর্টে হাজির করার পর অপহৃত শিশুকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে লুপা তালুকদার দাবি করেছেন, মেয়েটিকে নিজের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। যদিও এজন্য মেয়ের বাবা-মার কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেননি। বিষয়টি রহস্যজনক হওয়ায় তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’ ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম জানান, জিনিয়াকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সোমবার মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানা এলাকা থেকে লুপাকে গ্রেপ্তার করে ডিবির রমনা জোনাল টিম। জিনিয়া টিএসসি এলাকায় ফুল বিক্রয় করত এবং তার মা সেনুয়া বেগমের সঙ্গে টিএসসি এলাকাতেই থাকত। জিনিয়ার মা গত ২ সেপ্টেম্বর মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে শাহবাগ থানায় একটি জিডি করেন। জিডির তদন্ত, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যমতে জানা যায়, দুজন নারী ফুচকা খাওয়ায় জিনিয়াকে। তাকে নিয়ে টিএসসি এলাকায় ঘোরাফেরা করে। একপর্যায়ে কৌশলে বাসায় নিয়ে যায়।

এদিকে নিজের বহু অপকর্মের বিতর্ক সামাল দিতে না পেরে নিজেকে রক্ষায় একসময়ে লুপা পাড়ি জমান রাজধানীতে। রাজধানীর বিভিন্ন মিডিয়াপাড়ার পাশাপাশি অন্ধরমহলে এই লুপার বেশ সখ্যতা থাকার কথা ওঠে। ফের জড়িয়ে যায় রাজধানীর আণ্ডারওয়ার্ল্ডে। অপরাধজগতেও লুপার বেশ কদর বেড়ে যায়। এরপর আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি তাকে। বহুবিধ কায়দায় প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে আসছিলো। চাঁদাবাজীর অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বিভিন্ন সূত্রের ভাষ্য-অসংখ্যবার বিয়ের পিড়িতে বসার নাটক করে অনেক যুবককে জিম্মিদশায় রেখে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। লুপার চারটি বিয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এরমধ্যে গলাচিপায় একটি, পটুয়াখালীতে একটি,রাজধানী ঢাকায় একটি এবং বগুড়ায় একটি বিয়ে করার খোঁজ মিলে। লুপা গোপন অভিসারে সময় কাটানোর মধ্যে দিয়ে ধন্যাঢ্য ব্যক্তিদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণার জন্ম দিয়ে আসছিলেন। ‘মোতালেব প্লাজার’ পেছনে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। বছরখানেক আগে ওই বাসা থেকে লুপার এক ছেলের লাশ উদ্ধার করা হয়। তখন লুপা বলেছিলেন, ছেলে আত্মহত্যা করেছে। মূলত : অন্ধকার জগতের আড়ালে ঢাকায় সাংবাদিক পরিচয়ে লুপা বেপরোয়া জীবনযাপন করতেন। বিধিবাম-শেষ রক্ষা হলো না অন্যায় অপকর্মের ফিরিস্তি রচনা করা নূর নাজমা ওরফে লুপা তালুদারের।
—————

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক ও বার্তা প্রধান, ৭১’র মুখপত্র দৈনিক বিপ্লবী বাংলাদেশ।
3 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন