২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিকতা কেন প্রয়োজন

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:২৮ অপরাহ্ণ, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

ড. মো. হুমায়ুন কবির ::  স্বাধীন বাংলাদেশ এবং তার প্রতিটি নাগরিক অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন। এদেশের মানুষের শিক্ষার হার যাই থাকুক না কেন রাজনৈতিকভাবে বাঙালি জাতিগতভাবেই রাজনীতি সচেতন। তা বাঙালি শতাব্দীর পর শতাব্দী, যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ধরে প্রমাণ করে চলেছেন। মোঘল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ হটাও আন্দোলন, দীর্ঘ সংগ্রামে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানি হটিয়ে লক্ষ প্রাণ ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি- তার সবটুকুর কৃতিত্বই ছিল বাঙালির অদম্য বিবেচনাপ্রসূত রাজনীতি সচেতনতা।

রাজনীতি সচেতন এসব গর্বিত নাগরিকের কাছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালির রাজনৈতিক জীবনে অশেষ গুরুত্ব বহন করে চলেছে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে সেসব স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর তা-ব এখনো কেউ ভুলতে পারছেনা।

এখনো তাদের মানবতা বিরোধী তা-বের সাক্ষর বয়ে চলেছে ভুক্তভোগীরা। কিন্তু সেসব স্বাধীনতা বিরোধীদের মানবতা বিরোধী অপরাধের পরও পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে তাঁদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেয় অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়।

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এটি একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা যেখানে চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীদেরকে শুধু রাজনৈতিকভাবে পূণর্বাসন করেই ক্ষান্ত হয়নি উপরন্তু তাদেরকে এমপি মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু এদেশে অনেক রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করলেও কর্মকান্ডে তেমনটি কখনই দেখা যায়নি। অপরদিকে যতবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে ততবারই স্বাধীনতা বিরোধীদেরকে রুখে দিতে পেরেছে। চারদশক পর বিচার হয়েছে সেসব মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের। যা আগামীতেও অব্যাহত থাকার প্রত্যয় রয়েছে বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হলে।

২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ একটি অন্যতম মাত্রা পেয়েছিল। তখন সারাদেশে জঙ্গিবাদ এমনভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল যেখানে কোন মানুষই তাদের কাছে নিরাপদ ছিলনা। কিন্তু ২০০৮ সালের পরে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর আস্তে আস্তে সেগুলোকে কমিয়ে এনে বর্তমানে তা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার প্রয়াস পেয়েছে। বর্তমানে তাদের মূলোৎপাটনের কাজ চলছে। আশা করা যায় আগামীতে এ সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারলে তা একেবারেই বন্ধ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ক্রম অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশ। কারণ এখানকার শতকরা প্রায় আশি ভাগ নাগরিকই গ্রামীণ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত। আর সেজন্যই কৃষির উন্নতি ও সমৃদ্ধির সাথে দেশের সার্বিক অর্থনীতির একটি সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতি বিবেচনায় যেমনি প্রতিবছর একটি বার্ষিক বাজেট প্রণীত হয়ে থাকে। তেমনি স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি কিংবা দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন মিশন, ভিশনও ঠিক করা হয়ে থাকে। সেরকমভাবে বাংলাদেশের জন্য রয়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা যথা- পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, রয়েছে মিশন-২০২১, রয়েছে পরিকল্পনা-২০৩০, ভিশন-২০৪১ এবং আরো রয়েছে আগামী একশত বছরের জন্য ডেল্টা বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অরো অনেক ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। এমন কোন একটি সেক্টর খোঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে শেখ হাসিনার হাতের উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত পাঁচ বছর এবং বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত একটানা দশ বছরে প্রতিটি সেক্টরে যে অভাবনীয় উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা সাধিত হয়েছে তা এমন হাজার হাজার পৃষ্টার নিবন্ধ লিখেও শেষ করা যাবে না। তিনি এমন উন্নয়ন করেছেন যার মাধ্যমে দেশ বিদেশে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। একসময় তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নের রোল মডেল। আমি সেগুলো উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য ছিটেফোঁটা অংশই এখানে শুধু সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আর তখনই, কেন এ সরকারেরই ধারাবাহিকতা দরকার তা পরিষ্কার হয়ে যাবে অনেকাংশে।

যেমন ধরা যাক মাথাপিছু আয়। নব্বইয়ের দশকে দেখেছি বাংলাদেশে তা ৩০০ মার্কিন ডলারের কম ছিল। ২০০৬ সালে ৫৬০ ডলার, ২০০৯ সালে ৭১০ ডলার এবং ২০১৮ সালে এসে ১৭৫২ মার্কিন ডলার। বৈদিশিক বিনিয়োগ ২০০৬ সালে ৪৫.৬ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৯৬.১ কোটি ডলার এবং ২০১৮ সালে এসে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। রপ্তানি আয় ২০০৬ সালে ১.০৫ বিলিয়ন ডলার, ২০০৯ সালে ১.২৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮ সালে এসে ৪১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৬ সালে ০.৩৪ বিলিয়ন ডলার, ২০০৯ সালে ১.০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮ সালে এসে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

রেমিটেন্স আয় ২০০৬ সালে ৪৮ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৯৭ কোটি ডলার এবং ২০১৮ সালে এসে ১৪৯ কোটি মার্কিন ডলার। মাতৃত্বকালীন ছুটি ৪ মাস থেকে বাড়িয়ে ৬ মাস। কৃষি ভর্তুকি ২০০৬ সালে ০ কোটি টাকা, ২০০৯ সালে ৫৭৮৫ কোটি টাকা এবং ২০১৮ সালে এসে ১০৩৭৬ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০০৬ সালে ৩৩৭৮ মেগাাওয়াট, ২০০৯ সালে ৪৯৪২ মেগাওয়াট এবং ২০১৮ সালে এসে ২০৪৩০ মেগাওয়াট। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০০৬ সালে ১৭৬ কিলোওয়াট/ঘণ্টা, ২০০৯ সালে ২২০ কিলোওয়াট/ঘণ্টা এবং ২০১৮ সালে এসে ৪৬৪ কিলোওয়াট/ঘণ্টা। মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০০৬ সালে ৪২, ২০০৯ সালে ২৭, ২০১৮ সালে এসে ১২৩ টি। বিদ্যুতের আওতাধীন জনগোষ্ঠী ২০০৬ সালে ৩৮%, ২০০৯ সালে ৪৭% এবং ২০১৮ সালে এসে ৯৫%।

দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালে ৪১.৫%, ২০০৯ সালে ৩৪% এবং ২০১৮ সালে এসে ২১.৮%। অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ২০০৬ সালে ২৪.২%, ২০০৯ সালে ১৯.৩% এবং ২০১৮ সালে এসে ১১.৩%। রেমিটেন্স আয় ২০০৬ সালে ৪৮ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৯৭ কোটি ডলার এবং ২০১৮ সালে এসে ১৪৯ কোটি মার্কিন ডলার। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২০০৬ সালে ৬.৬৩, ২০০৯ সালে ৫.৭৪ এবং ২০১৮ সালে এসে ৭.৮৬। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে অবস্থান ২০০৬ সালে ৯১তম, ২০০৯ সালে ৯৩তম এবং ২০১৮ সালে এসে ৪৭তম। গড় আয়ু ২০০৬ সালে ৬৫.৪, ২০০৯ সালে ৬৬.৮ এবং ২০১৮ সালে এসে ৭২.১ বছর। বয়স্ক ভাতা ২০০৬ সালে ২০০ টাকা, ২০০৯ সালে ২৫০ টাকা এবং ২০১৮ সালে এসে ৫০০ টাকা। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ২০০৬ সালে ৫০০ টাকা, ২০০৯ সালে ৯০০ টাকা এবং ২০১৮ সালে এসে ১০০০০ টাকা।

এভাবে বলতে বলতে শেষ করা যাবেনা। তরপরও আরো কতশত উন্নয়ন বাদ থেকে যায়। যেমন ধরা যায় নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু। ঢাকায় উড়াল সেতু নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপন, দেশকে পুরোপুরি ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর, সবার হাতে হাতে মোবাইল পৌঁছে দিয়ে তাদেরকে ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা। রেল ও সড়ক যোগাযোগের অভুতপূর্ব উন্নয়ন সাধন। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ইতিহাসে সমৃদ্ধকরণ, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটানো, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালীকরণ, জেলায় জেলায় সরকারি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউিট, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকরণ ইত্যাদি ইত্যাদি।

সবচেয়ে বড় কথা হলো উন্নয়নের সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও সমুন্নত রাখা। কারণ এদেশে একসময় মুক্তিযুদ্ধারাই ছিলেন সব থেকে বেশি অবহেলিত। এখন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণার্থে তাদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় হয়েছে। আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এ সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর তা হলো তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গ্রোথিত হওয়া। কারণ একসময় অনেকেই মনে করতেন তরুণ প্রজন্ম হয়তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা পোষণ করেন না। কিন্তু এ সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে তাদের অবস্থানে প্রবীণ নাগরিকগণ খুবই আশার আলো পেয়েছেন মর্মে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বারংবার। আর সত্যিকার অর্থে এসব কারণেই আসছে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে বিজয়ের এ মাসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির আরো একটি বিজয় নিশ্চিত করাই হবে প্রগতিশীল মানুষদের জোর প্রত্যাশা।

লেখক : রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত), জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

2 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন