১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

সম্প্রীতির দেশে শকুনের থাবা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৬:০২ অপরাহ্ণ, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯

ওয়াসিম ফারুক:: ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় গত ২০ অক্টোবর যেই নারকীয় তাণ্ডব ঘটেছে তা সত্যি নিন্দনীয় ও দুঃখজনক সে সঙ্গে আতঙ্কিত হওয়ার মতোও বটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামে এক হিন্দু যুবক আল্লাহ ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বার্তা মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা।

আগে কক্সবাজারের রামুতে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই যুবকের ফেসবুক আইডি হ্যাক ও সাম্প্র্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করেছিল কুচক্রী মহল। ভোলার বোরহানউদ্দিনের ঘটনা, রামু ও নাসিরনগরের ঘটনারই অবিকল নকল। বোরহানউদ্দিনে সেই হিন্দু ছেলেটি নাকি ওইদিনই থানায় সাধারণ ডায়েরি করে প্রশাসনকে অবহিত করেছেন যে তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। এমন কি সংবাদমাধ্যমে পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী ওই ছেলে যখন থানায় সাধারণ ডায়েরি করার জন্য অবস্থান করেন ওই মুহূর্তে তার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদার দাবি করে ফোন করা হয় আর ওই ফোনের সূত্র ধরে পুলিশ বোরহানউদ্দিনের কাচিয়া ইউনিয়নের মো. ইমন ও রাফসান ইসলাম শরীফ ওরফে শাকিল নামে দুই হ্যাকারকে গ্রেফতার করে।

হিন্দু যুবকের আল্লাহ ও মহানবী (সা.) নিয়ে বাজে মন্তব্যের সংবাদ যখন ভোলার চারদিকে ছড়িয়ে পরে ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে ২০ অক্টেবর ডাকা হয় প্রতিবাদ সভা। প্রশাসনের তরফ থেকে এর আগেই এলাকার মুসল্লি ও আলেম সমাজকে আসল ঘটনা জানানো হয় এবং দোষীদের গ্রেফতারের কথা জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ স্থগিত করার আহবান জানানো হয়। তারপরও ২০ অক্টোবর সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মানুষ জড়ো হতে থাকে উপস্থিত জনতাকে আশ্বস্ত করতে।

বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ও ইউএনওকে নিয়ে পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করে প্রয়োজনীয় সব আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে তাদের বার বার আশ্বস্ত করেন। তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে সমবেত লোকজন ঈদগাহ ময়দান ত্যাগ করেন। তারপর একদল লোক বিনা উসকানিতে মাদ্রাসার অফিস কক্ষে অবস্থানরত কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ করে। আক্রমণকারীদের একদল আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ ও অন্য কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণকারীদের গুলিতে পুলিশের একজন মারাত্মক জখম হয়। মারাত্মক আহত হন পুলিশের আরেক সদস্য। বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজিও আহত হন পরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে চারজন সাধারণ মানুষ নিহত ও শতাধিক আহত হন এর মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশও আছেন।

ইতোমধ্যে আমরা জনতে পেড়েছি বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য শুভসহ তিনজনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। এখানে শুভ যেহেতু প্রশাসনকে অবহিত করেছেন এবং পুলিশও যেহেতু তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে শুভর ফেসবুক আইডির হ্যাকার ও চাঁদা দাবি করা ব্যক্তিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন তবে কেন শুভকে কারাগারে যেত হলো? যেহেতু এটা আদালতের বিষয় তাই আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখাটাই আমাদের কর্তব্য। এখানে আলেম সমাজ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যেহেতু প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কথায় আশ্বস্ত হয়েছেন তারপরও কোন উদ্দেশে কি স্বার্থ হাসিলের জন্য কে বা কারা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ওপর হামলা চালিয়ে এমন অরাজক পরিস্থিতির জন্ম দিল?

নিহত চার জনের ময়নাতদন্ত শেষে দু’জনের মাথা ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে থেঁতলানো ছিল বলে চিকিৎসকের বরাত দিয়ে পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। পুলিশ ওখানে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছেন তাই নিহত চারজন যদি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হতেন তবে সবাই গুলিতে নিহত হতেন এখানে কারা ভোঁতা অস্ত্র ব্যবহার করে দু’জনকে হত্যা করল। আমাদের সমাজে কিছু ধর্মান্ধ ও স্বার্থকামী লোক আছেন যারা ধর্মকে পুঁজি করে সব সময়ই নিজের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত এর জন্য তারা কাজে লাগান সমাজের ধর্মান্ধ মানুষদের। সে সঙ্গে ব্যবহার করেন এতিম অসহায় শিশুদের। এটা প্রত্যেক ধর্মের মধ্যেই আছে তার জন্যই আমাদের দেশে এমন গুজবের মাধ্যমে ধর্মের উন্মাদনা ছড়িয়ে নানান অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় মাঝে মাঝে।

এই সুযোগে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জান ও মালের ক্ষতি পর্যন্ত হচ্ছে। এই ধর্মীয় উন্মাদনার শিকার হয়ে আমাদের পাশের দেশগুলোতেও কিন্তু খুন-খারাবি প্রায় হয়। গরুর মাংস খাওয়া বা রাখার অপরাধে প্রায়ই ভারতে মুসলমানদের ওপর চলে নির্যাতন। ধর্ম নাকি মানুষকে শান্তির পথে আনে ধর্ম মানুষকে নাকি শৃঙ্খলার মধ্যে আনে। তবে ধর্মের নামে বা ধর্মকে পুঁজি করে যারা ব্যক্তি সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন করছে সমাজে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিচ্ছে তাদের কি নামে ডাকব?

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম শুভ নামের হিন্দু ছেলেটি মহানবী (সা.)কে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে কোনো বাজে মন্তব্য করেই ফেলেছে। তার জন্য কি সমাজের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়? দেশে আইন আছে অপরের ধর্মকে অবমাননার জন্য তাকে অবশ্যই আইনের মাধ্যমে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয় গুটি কয়েক মানুষের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। এর আগের এই ধরনের যেসব ঘটনাগুলো ঘটেছে তার বিচারের জন্য আমাদের প্রশাসন কি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পেরেছে? যদি পেরে থাকে তার বিচারের নিষ্পত্তিরই বা কি ব্যবস্থা হয়েছে? একটি ঘটনা ঘটার পর যদি দ্রুততার সঙ্গে বিচারের ব্যবস্থা করে অপরাধীদের সাজা কার্যকর করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে।

আশা করবো ভোলায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দ্রুত ফিরে আসবে এবং ধর্মনির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। সোস্যাল মিডিয়ার পোস্টকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি ও পুলিশ প্রশাসনের তরফে উদ্যোগের পরও কেন পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেল না তা সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত মাধ্যমে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার এখনই সময়।

লেখক- ওয়াসিম ফারুক: সাংবাদিক।

5 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন