২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী হেলমেটধারীরা কারা?

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৩৪ অপরাহ্ণ, ১১ আগস্ট ২০১৮

কারা এই হেলমেটধারী হামলাকারী যারা লোহার রড, রামদা, লাঠিসোটা নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করলো দায়িত্বরত গণমাধ্যমকর্মীদের? ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেললো, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করলো? গত কয়েকদিন ধরেই এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। ইতোমধ্যে তথ্যমন্ত্রী তথ্য দিয়েছেন হামলাকারীদের সনাক্ত করা গেছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে অনুরোধও করেছেন। এবার হয়তো রাজপথে নেমে হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সাংবাদিকরা হামলকারীদের হেলমেট খোলা নগ্নমুখ দেখতে পাবেন।

তবে কিছু প্রশ্ন আমাদের তাড়া করেই ফেরে। গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের, বিশেষত সরকারপ্রধানের উদার দৃষ্টির পরেও কেন, কীভাবে হামলার ঘটনা ঘটলো? যদি ধরেই নিই, সাংবাদিকদের ওপর হামলে পড়া হেলমেটধারীরা সরকারবিরোধী অপশক্তি, যারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে পথে নেমেছিল; তাহলে তাদের সম্পর্কে গোয়েন্দাদের কাছে কোনো তথ্য কি ছিল না? থাকলে তাদের হটিয়ে দেয়া হয়নি কেন? না থাকলে প্রশ্ন উঠতে পারে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর ভেতর কি কোনো ফাঁকফোকর তৈরি হয়েছে, যে ফাঁকফোকর গলিয়ে এসব অপশক্তি ঢুকে পড়েছে অরাজকতা সৃষ্টি করতে? চোখের সামনে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নির্মম হামলার সময় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর নীরবতাও নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।

বিপরীতভাবে যদি ধরে নিই, হেলমেটধারীরা সরকারসমর্থক, যারা রাজপথের নৈরাজ্য ঠেকাতে ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী অপশক্তিকে প্রতিহত করতে এসেছিল, তাহলে তো তাদের অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করতেই পারি। সরকার তো ক্ষুদেশিক্ষার্থীদের বিশুদ্ধ আন্দোলনে কোথাও কোনো বল প্রয়োগ করেনি। তাদের আন্দোলন যে যৌক্তিক এবং সময় উপযোগী তা স্বীকার করেও নিয়েছে গোটা সমাজ। সে কারণে নৈরাজ্যসৃষ্টিকারীদের প্রতিহত করার উদ্যোগ কল্যাণকর এবং নৈতিকতারই পরিচয় বলে আমরা মনে করি। কিন্তু হেলমেট পরে নিজেদের আড়াল করে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করার ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, নানা প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে। তাহলে কি ধরে নেব, সরকারসমর্থকদের মধ্যে ছদ্মবেশে থাকা অনুপ্রবেশকারীরাই এ হামলার পেছনের শক্তি?

সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে তো যাবেনই, সেটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব। তারা ছবি তুলবেন, ঘটনার সত্যতা যাচাই করবেন। তাদের এসব পেশাগত কাজের ধরন, স্টাইল, ঝুঁকি নেয়া- এসবতো আজকের অবুঝ শিশুরাও জানে, বোঝে। তাহলে যেসব হেলমেটধারী সাংবাদিকদের রক্তাক্ত ঝরালো তারা কি বুঝেশুনেই এটা করেছে? এর পেছনে কি গভীর কোনো দুরভিসন্ধি ছিল? হামলকারীরা যদি নৈরাজ্য ঠেকাতেই আসে, তাহলে সাংবাদিকদের ওপর হামলে পড়া কি তার মধ্যে পড়ে? জানা প্রয়োজন আমাদের। সরকারের কোনো সংস্থা বা ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতা কি তাদের এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন?

এসব প্রশ্নের উত্তর হামলাকারীদের কাছেই থাকতে পারে। তবে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদেরও এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করা উচিত। কেননা, বার বারই উচ্চারিত হচ্ছে, সরকার বা দেশবিরোধী অপশক্তির অনুপ্রবেশ ঘটছে ক্ষমতাসীন দল এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে। স্বার্থপরতা আর লোভের শিকার হওয়া মহলের উদাসীনতায় একাত্তরের পরাজিত শক্তি এই অনুপ্রবেশের সুযোগ করে নিয়েছে। পরাজিত শক্তির সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মিথস্ক্রিয়াও ঘটে চলেছে ভেতরে ভেতরে। এসব প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বেসামাল পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য নানা ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত চলছে বলেও গণমাধ্যমে নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় রেখেই গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।

বলা বাহুল্য, বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা আমাদের এটাই ভাবতে বাধ্য করে যে, এদেশে অনগ্রসর, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারন করা মিডিয়া বার বারই মুখ থুবড়ে পড়েছে। সংস্কৃতিগতভাবেই এদেশের সাংবাদিক আর সংবাদকর্মীরা অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করে, সমৃদ্ধ করে। তাই এখানকার গণমাধ্যম শিল্পের প্রসার ঘটেছে অগ্রসর আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ভিত্তি করেই। নীতিগতভাবেই সাংবাদিকরা বৈষম্যবিরোধ, আধুনিক ও উন্নত সভ্যতার অনুগামী। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই গণমাধ্যমের সবচেয়ে বেশি আনুকূল্য পেয়ে থাকে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল। যে বাস্তবতার কারণে অনগ্রসর, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক চেতনাধারীরা প্রায়শই গণমাধ্যমকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের দালাল বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। আর এমন বাস্তবতার ফলস্বরূপ প্রকৃত সাংবাদিকদের একটা স্বয়ংক্রিয় অবস্থানই তৈরি হয়ে যায়। যার ওপর কোনোই হাত থাকে না তাদের। আর তাই সময় সময়, দমন-পীড়ন আর অনেক অভিযোগও নীরবে হজম করে দেশপ্রেমের কাজ করে যেতে হয় সাংবাদিকদের। তবে এটাও সত্য, প্রকৃত সাংবাদিক কারো বন্ধু হতে পারে না, যেমন পারে না কারো শত্রু হতে।

আমরা খুব শিগগিরই জানতে পারবো, হামলাকারী হেলমেটধারী আসলে কারা। কেন তারা সাংবাদিকদের ওপর হামলে পড়ে রক্ত ঝরালো, তাদের ক্ষোভ আর প্রতিবাদের ভাষাকে উসকে দিয়ে রাজপথে নামার সুযোগ করে দিল, কিছুটা হলেও সরকারের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার পথ করে দিল- এসবও জানতে পারবো। তবে এটাও সত্য যে, সাংবাদিকদের রক্ত ঝরানো কোনোভাবেই কারো জন্য শুভ নয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরাও তা স্বীকার করবেন। তাই এ নিয়ে সরকারের শক্ত অবস্থান তো থাকবেই।

আমাদের এটা মানতেই হবে যে, পৃথিবী আর আগের জায়গায় নেই। গণমাধ্যমের ওপর হামলা করে পর্দার আড়ালে গিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আমরা এখন তথ্যের মহাসড়কে হাঁটছি, তথ্য গোপন করার কোনোও সুযোগ নেই। একটা সুন্দর বিশুদ্ধ আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য সরকারবিরোধী যে গুজববোমা তৈরি করা হলো তার বিস্ফোরণ কিন্তু ঘটাতে পারেনি কেউ। হেলমেটধারীরাও যেভাবে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে তা তথাকথিত, খুবই গতানুগতিক- বলা যায় জিওগ্রাফি বা ডিসকভারি চ্যানেলে দেখানো বন্যপ্রাণিদের সামাজিক চিত্র। এ ধরনের হামলা সরকার কোনোভাবেই সমর্থন করে না। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছি। সরকারের উদ্যোগ সারা বিশ্বে প্রশংসনীয় হয়েছে। মহাকাশ জয় করেছি। পারমাণবিক বিশ্বের গর্বিত সদস্যও হয়েছি। তথ্য প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির এ যুগে অতি আধুনিক-অগ্রসর ধারার আমাদের প্রজন্মের বেছে নেয়ার মতো রাজনৈতিক দল কিন্তু নেই-ই বলা যায়। তারপরেও জোর দিয়েই বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটিই হতে পারে এ প্রজন্মের অভূতপূর্ব স্বপ্নপূরণের একটা পথ। সেই পথকে তো হতে হবে ভিন্নমাত্রার ভিন্ন ধারার।

আগামীর পৃথিবীর যুদ্ধ কিন্তু হাতুড়ি, রড কিংবা রামদা দিয়ে নয়। সামনের বিশ্বকে মুখোমুখি হতে হবে তথ্যপ্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক যুদ্ধের। যে যুদ্ধের প্রধান অস্ত্রই হবে তথ্য আর প্রযুক্তি। পৃথিবী থেকে বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার ধারনাও ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করেছে। অন্য এক পৃথিবী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের নাগাল ধরতে চাইলে যারা জিওগ্রাফি বা ডিসকভারি চ্যানেলে দেখানো বন্যপ্রাণিদের দৃশ্যায়ন করতে চায় তাদের অপতৎপরতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এটা আগে বুঝতে হবে আমাদের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের; তারপর রাজপথের আন্দোলনে বাধাদানকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদেরও।

তবে আশার কথা হচ্ছে, একটা অভূতপূর্ব-নান্দনিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের শিশুরা অনেক বড় এক বার্তা দিয়ে গেছে। যারা চারপাশের সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য তারা আরো বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। ধর্মান্ধতার পাশাপাশি নানা সঙ্কট আর প্রতিকূলতার মধ্যে যেসব রাজনীতিকের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছিল তারাও নতুন দিনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার কথা ভাবতে শুরু করেছেন। আর এমন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন সাংবাদিকরাই।

লেখক: সাংবাদিক, mineon71@gmail.com

1 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন