বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৭:০১ অপরাহ্ণ, ১৫ নভেম্বর ২০১৮
বরিশাল অঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে- ‘তারিখ দিয়া মারামারি হয় না।’ ঘূর্ণিঝড় সিডরের আগেও উপকূলের মানুষ ঠিক এই কথাটিকেই একটু ঘুরিয়ে বলেছিলেন, ‘তারিখের বইন্যা (বন্যা) হয় না’। যে কারণে স্থানীয় প্রাশসন ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের পক্ষ থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের হুঁশিয়ারি দেয়া হলেও স্থানীয়রা এটিকে খুব একটা আমলে নেননি। তারা ভেবেছিলেন শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না। সেই একই ভাবনা ছিল আমারও।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। কাজ করি দৈনিক যায়যায়দিনে। বিকেলে চিফ রিপোর্টার মাসুদ কামাল (বর্তমানে বাংলা ভিশনের সিনিয়র নিউজ এডিটর) বললেন, ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানবে। আমি যেন দ্রুত উপকূলে রওনা হই। কিন্তু উপকূলের জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতায় মনে হলো, এটি খুব বড় কিছু হবে না। কিন্তু রাত সাড়ে ১০টার দিকে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথেই এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে থাকে। খোদ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঝড়ের যে তাণ্ডব দেখা গেলো, তাতে সহজেই এটি আন্দাজ করা যাচ্ছিলো যে, উপকূলের উপর দিয়ে কী ভয়াবহ বিপদ বয়ে যাচ্ছে। ভয়ে-আতঙ্কে বাসায় ঢুকতে না ঢুকেতেই চিফ রিপোর্টারের ফোন। তিনি কিছুটা ধমকের সুরেই বললেন, যেভাবেই হোক ভোরেই যেন আমি রওনা হই।
এরইমধ্যে উপকূলের উপর দিয়ে স্মরণকালের ভয়াবহ তাণ্ডব বয়ে গেছে। ধারণা করা অমুলক নয় যে, সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে এ অবস্থায় কী করে বরিশাল বিভাগে পৌঁছাব তা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছাই এবং একটি বাসে চেপে বসি। আরিচা ফেরিঘাট অব্দি পৌঁছাতে রাস্তায় খুব একটা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়নি। কিন্তু ফেরি পার হওয়ার পর একুট পরপরই রাস্তার উপরে বড় গাছ ও ডালপালা পড়ে থাকায় গাড়ি থামিয়ে বাসের সহকারী ও যাত্রীদের সহায়তায় সেই গাছ সরিয়ে আবার যাত্রা শুরু। বেশি সময় লাগে গৌরনদী এলাকা পার হতে গিয়ে। এভাবে করে করে মধ্যরাতে পৌঁছাই বরিশাল শহরে। পরদিন ভোরে রাস্তাঘাটের এইসব বিপত্তি উপেক্ষা করে পৌঁছে যাই পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালি ইউনিয়নে।
সেখানে নেমেই আবিষ্কার করি, স্থানীয় প্রশাসনের উপর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষোভ। তাদের অভিযোগ, লোকমুখে নানারকম খবর শুনলেও সরকারি-বেসরকারি কোনোভাবে মাইকিং করা হয়নি। এমনকি পরিস্থিতি টের পেয়ে তারা যখন আশ্রয় কেন্দ্রে যান, সেখানে গিয়ে দেখেন প্রত্যেকটা রুম তালাবদ্ধ। উদ্বিগ্ন মানুষ তালা ভেঙে যে যার মতো আশ্রয় নেন। কিন্তু যারা আশ্রয় কেন্দ্রে বা অন্য কোনো উঁচু বাসাবাড়িতে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন, পাহাড় সমান পানির তোড়ে প্রস্তুতিহীন এসব অসহায় মানুষের মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। চরখালী সমতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, রাবেয়া বেগম নামে এক বৃদ্ধা কাঁদছেন অঝোরে। ছেলে মেয়েসহ তার পরিবারের নয়জনকে হারিয়েছেন তিনি। তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আশপাশে যারা রয়েছেন, তারও এ বৃদ্ধার কান্না দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না।
ঘটনার রাতের বর্ণনা দিতে আলতাফ হোসেন বলেন, সন্ধ্যা থেকেই টের পাচ্ছিলাম কিছু একটা হবে। কিন্তু পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। তাই যখন দেখলাম পাহাড় সমান উঁচু পানি ধেয়ে আসছে তখন বউ বাচ্চা নিয়ে পাগলের মতো ছুটে পাশ্ববর্তী এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিই। গোয়াল ঘরে থাকা গরু-ছাগল কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। পরদিন সকালে গিয়ে দেখি ঘরের কংকাল পড়ে আছে।
দেখা গেছে, পানির তোড়ে সুবিদখালী ইউনিয়নের কয়েক মাইল পাকা সড়ক বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ভেসে গেছে কয়েকশো বিঘা জমির ডাল। খালে বিলে যত্রতত্র মরে পড়ে আছে গবাদী পশু। মুচি ও কসাইরাও গরু সরিয়ে কুল পাচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ ভবন এবং সমতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় খিচুড়ি নেয়ার জন্য মানুষের ভিড়। স্থানীয় কিছু মানুষের উদ্যোগে তৈরি এ খাদ্য নিয়ে চলে হুলুস্থুল। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়নি।
(২)
ঘূর্ণিঝড় সিডর কৃষিভিত্তিক উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। ধান, রবিশস্য, গাছ, মাছ, ক্ষুদ্র ব্যবসা ইত্যাদি মিলিয়ে ঠিক কতো টাকার ক্ষতি হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে তা নিরূপন করা যায়নি। তবে ঘটনার ১৫ দিন পরে ৩০ নভেম্বর সরকারের তরফে যে হিসাব দেয়া হয়, সেখানে বলা হয়, ১২ লাখ ৭৫ হাজার ৩১৫ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই সময়ে জমিতে ছিলো আমন, ইরি ও স্থানীয় আরও কিছু ধান। তবে ইরি বা উফশী জাতের ধানের চেয়ে আমন ও দেশি অন্যান্য ধানের ক্ষতি কম চোখে পড়ে। স্থানীয় কৃষকরা এর কারণ হিসেবে স্থানীয় ধানের গোড়া তুলনামূলকভাবে শক্ত বলে জানান।
সিডরের তাণ্ডবে উপকূল অঞ্চলে ক্ষতি হয়েছে দুভাবে। প্রথমত জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অগণিত মানুষ, পশু-পাখি, বসতি। দ্বিতীয়ত ২৫০ কিলোমিটার বেগের ঘূর্ণি-হাওয়া উপড়ে ফেলেছে লাখ লাখ গাছপালা। গাছ উপড়ে পড়েছে ঘরের চালায়। ফলে দেখা গেছে, যত লোকের প্রাণহানি ঘটেছে, তার বড় অংশের মৃত্যু হয়েছে ঘরচাপা পড়ে। যেসব গাছ ভেঙে পড়ে, তার মধ্যে বেশি চোখে পড়ে রেইনট্রি, চাম্বল, মেহগনি, শিলকড়াই ও অ্যাকাশিয়া। অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশি বিভিন্ন ফলের গাছ; যেমন আম, জাম, আমলকি, ডেউয়া ইত্যাদি। তবে কোনো ক্ষতি হয়নি বলা চলে তাল, নারকেল, সুপারি ও খেজুর গাছের। হাতে গোনা কিছু সুপারি গাছ পড়ে গেলেও তা অন্য কোনো বড় গাছের আঘাতে পড়ে গেছে।
স্থানীয় প্রবীণরা এর কারণ হিসেবে বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় বায়ুর বেগ ও পানির স্রোত প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে নারিকেল ও সুপারি গাছ। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে নারিকেলের পানি ও শ্বাস পানীয় জল ও খাদ্যের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া শক্ত ও মোটা শিকড় থাকায় তেতুল, বট, অশ্বত্থ, বকুল, জারুল, নিম, গাব, জাম, অর্জুন ইত্যাদি গাছ ঘূর্ণিঝড়ের সময় সহজে উপড়ে যায় না। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসের সময় ভেলা হিসেবে কাজে লাগে কলাগাছ। ফলে তখন প্রশ্ন ওঠে, উপকূলে যে ধরনের গাছ বেশি থাকা দরকার, তা ছিল কি-না এবং সিডরের মতো ব্যাপকবিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের ১১ বছর পরেও উপকূলে গাছপালা লাগানোর ক্ষেত্রে সরকারের নীতি এবং স্থানীয়দের মানসিকতায় খুব বড় কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না।
উপকূলের পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠান কোস্টের গবেষণা অনুযায়ী, ৫০ বছরে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি প্রকল্পের দাপটে প্রায় ২২ হাজার একর আয়তনের চকরিয়া সুন্দরবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়। যেটি ছিলো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানবসৃষ্ট এ কারণ ছাড়াও ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন তথা উষ্ণতা বৃদ্ধিও আরেকটি বড় কারণ। কারণ ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, এতে করে উপকূলীয় অঞ্চলের নিম্নভূমি ও উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহের প্লাবিত হওয়া এবং ম্যানগ্রোভ ও জলাভূমির প্রতিবেশ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে গেছে।
এসব কারণে বলা হয় যে, উপকূলে যখন নতুন চর জেগে ওঠে, তখন সেখানে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, যেমন ক্যাওড়া গাছ বেশি করে লাগানো উচিত। মাটি একটু শক্ত হয়ে গেলে সেখানে লাগানো উচিত বাইন, গেওয়া এবং উপকূলের উঁচু জমির জন্য আদর্শ গাছ হলো শিশু, বাবলা, রেইনট্রি ইত্যাদি। উপকূলের বেড়িবাঁধগুলোয় বেশি করে বাবলা গাছ লাগানোর কথা। কারণ এ গাছের শেকড়ের মাটি আকড়ে ধরার ক্ষমতা অনেক বেশি। কিন্তু সিডর এবং এর দুই বছর পরে আইলার ধ্বংসলিলার পরে এই সময়ের ভেতরে উপকূলের জন্য কোনো বৃক্ষনীতি প্রণয়ন আদৌ সম্ভব হয়েছে কি না?
সিডরে ক্ষতি বাড়ার আরেকটি কারণ ছিলো আশ্রয় কেন্দ্রের স্বল্পতা। পাথরঘাটার পদ্মা গ্রামের মানুষ জানান, তারা যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে সিডর আঘাত হানছে, তখন আর সময় ছিল না। কারণ যাদের বাড়ি-ঘর আশ্রয়কেন্দ্রের খুব কাছাকাছি তারাই কেবল সেখানে যেতে পেরেছেন। কিন্তু যাদের বাড়ি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে দূরে, তারা ঠাঁই নিয়েছেন বেড়িবাঁধ বা উঁচু রাস্তায়। একই তথ্য জানা গেছে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় দুর্গত এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে। সেখানেও প্রয়োজনের তুলনায় আশ্রয় কেন্দ্র অপ্রতুল এবং অনেক আশ্রয় কেন্দ্রের অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। ফলে সেখানে আশ্রয় নেয়া মানুষও এক রকম আশ্রয়হীনতায় ভোগেন।
এ বিষয়ে একটা অদ্ভুত তথ্য দিয়েছিলেন পাথরঘাটা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিষখালি নদী তীরের সরকারি আশ্রয়ন প্রকল্পের মানুষ। তারা জানান, সরকারিভাবে যখন ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্কেত দেয়া হচ্ছিলো, তখন তারা ভেবেছিলেন তাদেরকে এ স্থান থেকে উচ্ছেদ করে সরকার এটি দখল করে নেবে। কারণ এর আগেও তারা এরকম কথা শুনেছিলেন। তাই নিজের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হবার ভয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন।
প্রয়োজনীয় স্থানে বেড়িবাঁধ না থাকাও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতি বৃদ্ধির আরেকটি কারণ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পাথরঘাটা উপজেলা শহর থেকে দক্ষিণে বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর মোহনা সংলগ্ন নাম পদ্মা এলাকায় একটি বেড়িবাঁধ রয়েছে। কিন্তু বাঁধের বাইরে থাকা ঘরগুলো সিডরের তাণ্ডবে লন্ডভণ্ড হয়ে গেলেও বেড়িবাঁধ বাঁচাতে পারেনি বাঁধের ভেতরের মানুষগুলোকেও। কারণ বাঁধের একটা বড় অংশ ভেঙে গিয়েছিল বছর কয়েক আগে। সেটি কার্যকরভাবে মেরামত করা হয়নি। সিডরের ১১ বছর পরেও যদি উপকূলের বিভিন্ন এলাকার দিকে আমরা তাকাই দেখব, ঝুঁকিতে থাকা বহু এলাকায় এখনও বেড়িবাঁধ নেই। সম্প্রতি শরীয়তপুরে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে শত শত বসতভিটা এবং একরের পর একর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। ফলে সিডর-আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে উপকূলের মানুষের জানমাল রক্ষায় পর্যাপ্ত এবং টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, উপকূলউপযোগী গাছ লাগানো তথা উপকূলের জন্য একটি বৃক্ষনীতি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
লেখক : সাংবাদিক।