২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

সুন্দরবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে এক সাংবাদিক!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৬:৩৪ অপরাহ্ণ, ০৭ নভেম্বর ২০১৮

‘পাইরেটস অব দ্যা সুন্দরবনঃ শান্তি প্রতিষ্ঠার নেপথ্য সাংবাদিক’

✪ আরিফ আহমেদ মুন্না ॥ সুন্দরবন আজ জলদুস্য মুক্ত হয়েছে। কয়েকদিন আগে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তবে এ অর্জনটি নেহায়েত সামান্য ছিল না। গত তিন দশক ধরে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন এলাকায় জলদস্যুদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে বাংলাদেশের হাজার হাজার জেলে। সর্বস্বান্ত হয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। কত হাজার মানুষ যে নিখোঁজ হয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। জলদস্যুদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংঘর্ষে কত প্রাণহানি ঘটেছে, রক্তক্ষয়ী কত যুদ্ধ আর গোলাবারুদের অপচয় হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠায় জলদস্যুদের এই আত্মসমর্পণের ঘটনা ছিল আরেকটি অনন্য মাইলফলক। এই সফলতার গল্পের নায়ক হিসেবে আমাদের র‌্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) নাম সবার জানা। তবে এর বাইরেও আরেক মহানায়ক রয়েছেন, যিনি রয়ে গেছেন নেপথ্যে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে।

ইতিহাসের পাতা খুঁজলে সুন্দরবনে জলদুস্যদের যেসব তান্ডবের কাহিনী পাওয়া যায় তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর এবং রুদ্ধশ্বাস আতঙ্কের এক উপাখ্যান। সাম্প্রতিককালে সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের কথা শোনা গেলেও আজ তারা অতীত। কিন্তু গত তিন দশক ধরে বঙ্গোপসাগর আর সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলের জলদস্যুরা ভারত-বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের ৩২টি জলদস্যু বাহিনী সুন্দরবনের দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় অবাধ রাজত্ব কায়েম করেছিল। দুই দেশের জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ দাবি, ট্রলার, টাকা, জাল আর মাছ কেড়ে নেওয়া ছিল নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। এদের দমন করতে যখন দু’দেশের নিরাপত্তা বাহিনী রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছিল ঠিক তখনই পেশার স্বার্থে খবর সংগ্রহের নেশায় সুন্দরবনে গিয়ে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করানোর মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে এখন সত্যিকারের হিরো হয়েছেন সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম।

বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভির সাংবাদিক মোহসীনের প্রায় আট বছরের প্রচেষ্ঠায় ৩২টি বাহিনীর ৩২৮ জন জলদস্যু ৪৭০টি দেশি-বিদেশি অস্ত্র এবং সাড়ে ২২ হাজার গুলিসহ আত্মসমর্পণ করেছে প্রশাসনের কাছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১ নভেম্বর সুন্দরবন জলদস্যু মুক্ত ঘোষণা করেছেন। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আয়লার পরে সুন্দরবনের বাগেরহাট অঞ্চলের গাবুরা গ্রামে সংবাদ সংগ্রহে গিয়েছিলেন মোহসীন। এই গ্রামের মানুষজন সুন্দরবনে যান জীবিকার তাগিদে মাছ ধরতে। সেই সময় গ্রামবাসীদের একটি কথা তাঁর মনকে নাড়া দেয়ে। “চারিদিকে শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন। কিন্তু সেটাকেও তারা বড় সমস্যা বলে ভাবছে না। তারা আমাকে বললেন, আমরা আর পারছি না। ভাই, যেভাবেই হোক জলদস্যু ঠেকানোর জন্য কিছু একটা করুন।” এভাবেই নিজের গল্প বলতে শুরু করেন এই অনন্য ঘটনার নেপথ্য মহানায়ক মোহসীন।

২০১০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো যোগাযোগ করেন মোতালেব বাহিনীর প্রধান মোতালেবের সঙ্গে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন জলদস্যু জীবন ছাড়তে। প্রথমে রাজি হলেও পরে মোতালেব পিছিয়ে যান। এর কয়েকদিন পর র‌্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বাহিনীর গুলিতে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু আশা ছাড়েননি মোহসীন। একের পর এক প্রতিবেদনে তিনি তুলে ধরতে থাকেন জলদস্যু এবং এই অঞ্চলের জেলেসহ অসহায় মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা। মোহসীন বলেন, আমি সুন্দরবন গেছি বারবার। গোটা অঞ্চলটা এক সময়ে আমার চেনা হয়ে যায়। জলদস্যুরা আমাকে চিনতে পারে। আমার সম্পর্কে জানতে পারে। তাদের সাথে আমি নিয়মিত যোগাযোগ করতাম, মোবাইল কথা বলতাম। একটা সময় পরে তারা আমাকে বিশ্বাস করে এবং আমার ওপর আস্থা রাখতে শুরু করে।

মোহসীন ঘুরে বেড়িয়েছেন জলদস্যুদের সঙ্গে। তাদের ডেরায় কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। তাদের বোটে করে ছুটে বেড়িয়েছেন সুন্দরবনের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। একবার কোস্টগার্ডের গুলির মুখেও পড়েছেন। তবে তিনি কখনোই ভুলে যাননি তার পেশাদারিত্ব। তাঁর কথায়, ‘আমি বিষয়টাকে দায়িত্ব এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে করার চেষ্টা করেছি। রিপোর্টিং-এর সময় কোনো পক্ষ নেইনি। কোনো আইন ভঙ্গ করিনি। প্রতিবার জঙ্গলে ঢোকার সময় আমি প্রশাসনকে জানিয়ে রাখতাম। আত্মসমর্পণের আলোচনা চালানোর সময়ও আমি জলদস্যুদের কোন ধরনের প্রতিশ্রুতি দেইনি। কোনো ধরনের সুবিধা নেইনি তাদের কাছ থেকে। ফলে তারা আমাকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে।

২০১৬ সালে মাস্টার বাহিনীর প্রধান কাদের মাস্টার মোহসীনের কথায় প্রথম রাজি হন আত্মসর্মপণের জন্য। ইতিমধ্যেই মোহসীনের টিভির প্রতিবেদনগুলো দেখে বাংলাদেশ সরকার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে তিনি বেশ কয়েকবার জঙ্গলে মাস্টার বাহিনীর ডেরায় যান। আত্মসমর্পণের জন্য তাদের লিখিত আবেদনপত্র সংগ্রহ করে সরকারের হাতে তুলে দেন। দীর্ঘ একবছর আলাপ-আলোচনার পরে মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। মোহসীন নিজে তাদের জঙ্গল থেকে বাইরে নিয়ে আসেন। এই আত্মসমর্পণের ঘটনায় অন্য বাহিনীগুলোর মধ্যে ভয় ছিল যে মাস্টার বাহিনীর সবাইকে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু যখন সেটা ঘটলো না, তখন সুন্দরবন থেকে বেরিয়ে এসে মজনু বাহিনী, ইলিয়াস বাহিনী, শান্ত বাহিনী, আলম বাহিনী, সাগর বাহিনী, খোকাবাবু বাহিনী, নোয়া বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, ছোটরাজু বাহিনী, আলিফ বাহিনী আর কবিরাজ বাহিনী তাঁর হাত ধরে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী মাস্টার বাহিনীর জলদস্যু শাহিন তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, “মোহসীন ভাই বললি পাঁচ তলা থিকি ঝাঁপ দিতি পারি। ওপর আল্লাহ আর নীচে এই ভাই”।

ভারতের জলসীমায় সুন্দরবন অংশে এই জলদস্যুদের সম্পর্কে মোহসীন জানান, জনাব বাহিনী, আলিফ বাহিনী ও মজনু বাহিনী ওপারে সুন্দরবনে অপারেট করতো। এরা সাতক্ষীরার রায়মঙ্গল নদী দিয়ে উত্তর তালপট্টি, মান্দারবেড়িয়া হয়ে কুলতলী পীরখালি পর্যন্ত যেতো। এরমধ্যে জনাব বাহিনী ভারতে ধরা পড়ে।

মোহসীন আরো জানান, এই জলদস্যুদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম সবাই ছিল। এখানে কোনো রাজনীতি নেই। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভেড়ির লাঠিয়াল হিসাবে এদের জীবন শুরু হতো। পরে বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হওয়ার কারণে পালিয়ে গিয়ে জলদস্যু হয়ে যেতো এরা। ছোট বাহিনীগুলো সুন্দরবনের নদীতে অপারেট করলেও বড় বাহিনীগুলো বঙ্গোপসাগরে অপারেশন করতো। মূলত চাঁদাবাজি আর মুক্তিপণ থেকে টাকা আদায় করাই ছিল এদের আয়ের মূল উৎস। ভারতীয় অংশে এদের এজেন্ট থাকতো। তারা মোবাইলে যোগাযোগ করে চাঁদার টাকা তুলতো। জলদস্যু বাহিনীগুলোর মধ্যে যারা অস্ত্রের মালিক ছিলেন তারা মোট আয়ের ৬০ শতাংশ পেতেন। বাকিটা দিয়ে দলের বেতন এবং অন্যান্য খরচ চলতো। দলের সদস্যদের মাসিক বেতন ছিল জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বড় জলদস্যু বাহিনীগুলোর মাসিক আয় ছিল গড়ে ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ বাংলাদেশি টাকা। আর ছোট বাহিনীগুলোর ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা। বড় বাহিনীগুলোর প্রায় সব অস্ত্রই বিদেশি। এরা আমেরিকা, তুরস্ক ও ভারতে তৈরি অস্ত্র বেশি ব্যবহার করতো। নাইন শুটার, এইট শুটার, সিং শুটার, ডাবল ব্যারেল, সিঙ্গেল ব্যারেল, একে-২২ অস্ত্রগুলোই বেশি ব্যবহার করতো তারা। আর ছোট দলগুলো দেশীয় বন্দুক, এলজি, ওয়ান শুটার প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করতো। ভারতের চম্বলের ডাকাতদের আত্মসমর্পণের পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এতোবড় আত্মসমর্পণের ঘটনার আর নজির নেই।

মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করা সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এক আলোচিত নাম হলেও এখনো তিনি এই কাজের জন্য পাননি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তাঁর কথায়,-“এটা আত্মপ্রচারের বিষয় নয়। সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে হয়েছে প্রতিদিনের খবর জোগাড়ের বাইরে যদি এমন কিছু করতে পারি, যাতে দেশ এবং দেশের মানুষের উপকার হয়। সেই ভাবনা থেকেই জলদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য কাজ শুরু করি। শেষ পর্যন্ত যে আমি সফল হয়েছি এটাই আমার আত্মতৃপ্তি।”

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন