২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

হঠাৎ উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ: ৩৮৭ রাজনৈতিক সংঘাতে ৫৮ মৃত্যু

বরিশালটাইমস, ডেস্ক

প্রকাশিত: ০১:১০ পূর্বাহ্ণ, ০১ অক্টোবর ২০২২

হঠাৎ উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ: ৩৮৭ রাজনৈতিক সংঘাতে ৫৮ মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যেই ঘটছে সহিংসতা। এসব ঘটনায় বলি মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও জমে ওঠে নোংরা খেলা। এ ছাড়া সহিংসতা দমনে অংশ নেওয়া পুলিশের গুলিতে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও ভোলায় রাজনৈতিক দলের কর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় উঠেছে নানা প্রশ্ন।

তবে সরকারের শীর্ষস্থানীয়রা প্রতিবারই বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় সব কিছুই করা হবে। অন্যদিকে, গত নয় মাসে বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ৩৮৭ ঘটনায় ৫৮ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৪০০ জন আহত হয়েছেন বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতি অনেক নেতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে নানা ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়ন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। চাহিদা বাড়বে পেশাদার অপরাধীদের।

রাজনীতির অঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ আনা সম্ভব না হলে এবার অপশক্তি মাথা চড়া দিয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তাঁরা। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মাদ আলী শিকদার বলেন, ‘রাজনীতি যখন মানুষের কাছে ব্যবসা হয়ে যায় তখন তো এসব সহিংসতা ঘটবেই। অর্থ, শক্তি ও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা না হলে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ কখনো প্রত্যাশা করা যায় না। যদিও আমরা হামেশাই এসব ভুলে যাই। বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি।

’ তিনি আরও বলেন, ‘সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থেই দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এসব বিষয়ে আলোচনা দরকার। জনগণের কল্যাণই যদি মূল উদ্দেশ্য হয় তাহলে এর কোনো বিকল্প নেই।’ গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ নূর খান স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। আসকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩১ জুলাই ভোলায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবিতে বিএনপির কর্মসূচি কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে।

 

পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন স্থানীয় নেতা, পরে আহতাবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ভোলা জেলা ছাত্রদল সভাপতিরও মৃত্যু হয়। ১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ এবং ২২ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন আরও দুই যুবদল কর্মী। এর আগে জুনে গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি সীতাকুন্ড বিস্ফোরণে আহতদের দেখতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে তাঁদের ওপর হামলা চালায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এতে জোনায়েদ সাকিসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত হয়নি। নির্বাচন এলেই সহিংসতা বেড়ে যায়। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি আন্দোলনে নামছে। আর আন্দোলন কেন্দ্র করে সহিংসতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণেই সহিংসতা ঘটে।’

সমঝোতা ও সংলাপ ছাড়া পথ নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক জিয়া বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে প্রধান দুটি দলের মধ্যে বড় ধরনের দূরত্ব কাজ করে। তবে এটা ঠিক, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার বোধোদয় না হলে আবারও অপশক্তি মাথা চড়া দিয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।’

থেমে নেই বন্দুকযুদ্ধ : আসক বলছে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর পুলিশ ও র‌্যাবের সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সাময়িক বন্ধ থাকলেও এপ্রিলে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আবারও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

তবে আগস্টে রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগ সভাপতি জিল্লুর হাকিম ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সমর্থন করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। গত নয় মাসে বিচারবহির্ভূতভাবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ১৫ ব্যক্তির মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।

আর সহিংসতার সর্বাধিক ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লায়, এরপর চট্টগ্রামে। কুমিল্লায় ২৫ সহিংসতার ঘটনায় দুজনের প্রাণহানিসহ ২৫৬ জন আহত হয়েছেন। চট্টগ্রামে ২৩ ঘটনায় ছয়জন নিহত ও ৩০২ জন আহত হয়েছেন।

আসকের তথ্যানুযায়ী, সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে চারজনকে অপহরণ করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

এর মধ্যে পরবর্তী সময় একজন ফেরত এসেছেন এবং একজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। দুজন এখনো নিখোঁজ।

কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরের মতো এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বছরের এ সময়ে দুটি ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের চার বাড়িঘরসহ আট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তদের হামলা ঘটেছে। ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে নড়াইলে হামলা ছিল উল্লেখযোগ্য।

নারী নির্যাতনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গত নয় মাসে নারীর প্রতি সহিংসতাও উদ্বেগজনকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হলসংলগ্ন এলাকায় পাঁচ দুর্বৃত্তের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন এক ছাত্রী।

যৌন হয়রানিকেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২০৯ নারী-পুরুষ, যার মধ্যে হামলার শিকার ১৩৬ নারী ও ৭৩ পুরুষ। এর মধ্যে বখাটেদের দ্বারা লাঞ্ছিত ১২০ জন, বখাটেদের উৎপাত কেন্দ্র করে সংঘাতে আহত হয়েছেন ৭৪ জন।

যাদের মধ্যে যৌন হয়রানির কারণে সাত নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের দ্বারা ছয় পুরুষ হত্যার শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩৪ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৪ নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাত নারী। এ ছাড়া ১২৮ নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে।

পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৬৭ নারী। এর মধ্যে ২২৮ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৬৭ নারী। এ ছাড়া শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭২ নারী।

যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪৮ নারী। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬৯ জনকে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ছয় নারী।

এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬২ জন। এ সময়ে ১৯ গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১১ নারী। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

আরও জানানো হয়, গত নয় মাসে ১ হাজার ২৭৮ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ২৪০ শিশু, বলাৎকারে ব্যর্থ হয়ে এক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৪৪ শিশু, বিভিন্ন সময় ৯১ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, রহস্যমৃত্যু হয়েছে ১৮ শিশুর।

এ ছাড়া বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৪৪ ছেলেশিশু। আর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিহত ৩৯৫ শিশুর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ সময় ঢাকায় ৫৪, নারায়ণগঞ্জে ২৪, গাজীপুরে ২১, কুমিল্লায় ১৬ ও চট্টগ্রামে ১৫ শিশু নিহত হয়েছে। ১৭৯ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। যার মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৬৬ সংবাদকর্মী। দুর্বৃত্তদের গুলিতে কুমিল্লায় নিহত হয়েছেন একজন সাংবাদিক।

13 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন