২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

২২৪ কিমি গতিবেগের ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় ৫ লাখ মানুষ!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৭:২৫ অপরাহ্ণ, ১৯ মে ২০২০

বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ইতিহাসে ইতিহাসের ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম বলা হয় ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’কে। ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের (সেসময়কার পূর্ব পাকিস্তান) উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় ২২২ থেকে ২২৪ কিলোমিটার গতিবেগের প্রলয়ঙ্করী এই ঘূর্ণিঝড়।

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, সিম্পসন স্কেলে ঝড়ের মাত্রা ছিল ‘ক্যাটাগরি- ৩’। ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২২২ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ৩০ ফুট। সেদিনের সেই প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপকূলকে প্রায় দুমড়ে দিয়েছিল। লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার মেঘনা উপকূলীয় চর আবদুল্লাহ, কমলনগর উপজেলার ভুলুয়া নদী উপকূলীয় চরকাদিরা, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশসহ বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন জেলা ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলা। সেই সময়ে সেখানে বসবাসরত এক লাখ ৬৭ হাজার লোকের মধ্যে প্রায় ৭৭ হাজারই প্রাণ হারায়। ভোলা সাইক্লোনের তাণ্ডবে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা উপকূলীয় রামগতি ও কমলনগর এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। মেঘনা ও ভুলুয়া নদীর উপকূলীয় চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ৮ থেকে ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। স্রোতে ভেসে যায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ অসংখ্য মানুষ।

ঝড়ে সম্পদ ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১০ লাখের বেশি গবাদিপশু প্রাণ হারায়। চার লাখ ঘরবাড়ি ও সাড়ে তিন হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের ঘটনায় ১০ লাখের মতো মানুষ মারা গেলেও ঝড়ের তিনদিন পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার মৃতের সংখ্যা ৫ লাখ বলে প্রচার করে। ছবি সংযুক্ত।

এই ঝড়টিই একমাত্র প্রলয়ংকরী ঝড় নয়। এর আগেও ১৮৭৬ সালের ২৯ অক্টোবর বরিশালের বাকেরগঞ্জে মেঘনা নদীর মোহনার কাছ দিয়ে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার। এই ঝড়ের প্রভাবে ১২ মিটারের বেশি জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় ঊপকূলীয় এলাকা। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালীর উপকূলে তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। তারও প্রায় একশ বছর আগে ১৭৬৭ সালে এই বাকেরগঞ্জেই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান ৩০ হাজার মানুষ।

এরপর ১৮২২ সালের জুন মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল, হাতিয়া ও নোয়াখালীতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা যান। ১৮৩১ সালে বালেশ্বর-উড়িষ্যা উপকূল ঘেঁষে চলে যাওয়া তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল উপকূলের ২২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৫৮৪ সালে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী ঘূর্ণিঝড়ে পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলার উপকূলের দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারান।

১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুবদিয়া দ্বীপ। ঝড়ে প্রাণ হারান পৌনে দুই লাখ মানুষ। ১৯০৯ সালের ১৬ অক্টোবর খুলনা অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান ৬৯৮ জন। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় মৃত্যু হয় ৫০০ জনের। এর চার বছর পর খুলনায় আবারও এক ঘূর্ণিঝড়ে ৪৩২ জন মারা যান।

১৯৪৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে ১২০০ অধিবাসী। ১৯৫৮ সালে বরিশাল ও নোয়াখালীতে ঝড়ে মৃত্যু হয় ৮৭০ জনের। ১৯৬০ সালে অক্টোবরে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়। ঝড়ের প্রভাবে ৪.৫-৬.১ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে মারা পড়েন ঊপকূলের প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা।

পরের বছর ১৯৬১ সালের ৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যান এই ঝড়ে। ১৯৬২ সালে ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল। এই ঝড়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন।

১৯৬৫ সালে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ১৯ হাজার ২৭৯ জন। সে বছর ডিসেম্বরে আরেক ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জনের। পরের বছর অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়। এতে মারা যান ৮৫০ জন। পরে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে, ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে, ১৯৭৪ সালের অগাস্টে ও নভেম্বরে, ১৯৭৫ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে উপকূলীয় এলাকায়।

তথ্যসূত্র:

১. esri.com
২. bbc.com
৩. bbc.com/Bengali

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন