স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারাদিয়ে সাত সদস্যর পরিবারের সবার অমতে দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন টগবগে যুবক ইসমাইল খান। একই গ্রামের সেনা সদস্য আব্দুল আজিজ হাওলাদারের উৎসাহে অন্যান্যদের সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তিনি ভারতে গমন করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল মুহুর্তে ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণের জন্য যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোঃ আউয়াল হাবিলদারের নেতৃত্বে দেশে ফেরার সময় সহযোদ্ধাদের সাথে তিনি একাধিকস্থানে পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষেরদিকে শ্যামনগর এলাকার একটি যুদ্ধে পাক সেনাদের ছোঁড়া গ্রেনেডে তার শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়। ওইসময় সহযোদ্ধা বাবুগঞ্জের কবির খান তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ভারতের হাসনাবাদ মেডিক্যালে ভর্তি করেন। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ্য হয়ে পূর্ণরায় তিনি দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আজও তার শরীরে গ্রেনেড হামলার ক্ষত চিহ্ন রয়েছে।

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের সাকোকাঠী গ্রামের মৃত গঞ্জর আলী খানের পুত্র ইসমাইল খান। বর্তমানে নানারোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসাসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ভূমিহীন মোঃ ইসমাইল খান (৬৮)। দেশ স্বাধীনের পর সরকারের মুক্তিবার্তা নং (লাল বই)-০৬০১১০০২৫৪, যুদ্ধাহত গেজেট নং-১৫০১, মুক্তিযোদ্ধা গেজেট নং-৩৪২৩, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদ নং-১৩৫২৫ অর্ন্তভূক্ত হয়ে শুরু থেকেই তিনি (ইসমাইল খান) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সম্মানি ভাতা পেয়ে সাত সদস্যর পরিবার নিয়ে কোনমতে খেয়ে পরে জীবন বাঁচিয়েছেন। একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রনে তিনি অসংখ্যবার জাতীয় পর্যায়ের অসংখ্য কর্মসূচীতে অংশগ্রহণও করেছেন।

ভূমিহীন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, তিনি প্রায় সময়ই বঙ্গবন্ধুর ছবি অঙ্কিত গেঞ্জি ও টুপি পরতেন। গত বছরের (২০১৫ সালের) প্রথমার্ধে স্থানীয় সাকোকাঠী মিশুকস্টান্ডে বসে বঙ্গবন্ধুর ছবি অঙ্কিত গেঞ্জি ও টুপি পরিহিত অবস্থায় তাকে দেখে অশ্লীলভাষায় গালিগালাজ করে শাহাজিরা গ্রামের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল খান ও তার সহযোগী অপর বিএনপি নেতা মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান হাওলাদার। একপর্যায়ে তারা ইসমাইল খানকে বিএনপিতে যোগদানের আহবান করায় তাদের সাথে ইসমাইল খানের তুমুল বাগ্বিতন্ডার জেরধরে ওই প্রভাবশালী বিএনপি নেতারা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানকে মারধর করে বঙ্গবন্ধুর ছবি অঙ্কিত গেঞ্জি টেনে ছিড়ে ফেলে। এর জেরধরে বিএনপি ও জামায়াতের দোসর মোজাম্মেল খান ও শাহজাহান হাওলাদার তাকে (ইসমাইল খান) ভূয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আখ্যায়িত করে ওই বছরেই মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাষ্টসহ বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ফলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাষ্ট থেকে গত ডিসেম্বর মাস থেকে অদ্যবর্ধি ইসমাইল খানের ভাতা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। এ কারণেই পরিবার পরিজন নিয়ে নানারোগে আক্রান্ত ইসমাইল খান এখন চরম অর্থকষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

ইসমাইল খান বলেন, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যে অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দপ্তর থেকে তাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, যুদ্ধকালীন জীবিত কমান্ডার, সহযোদ্ধা ও স্বাক্ষীদের নিয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রতিটি দপ্তরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, যুদ্ধকালীন কমান্ডার, সহযোদ্ধা ও স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণ করার পর তার পক্ষে রায় দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাষ্টের পরিচালকের সাথে সাক্ষাত করলে তিনি তার সকল কাগজপত্র পর্যালোচনাসহ যুদ্ধকালীন কমান্ডার, সহযোদ্ধা ও স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণ করে তার (ইসমাইল খান) পক্ষে রায় দিয়ে বলা হয়, সাময়িকভাবে বন্ধ ভাতা খুব শীঘ্রই চালু করা হবে। পরবর্তীতে দীর্ঘদিনেও ভাতা চালু না হওয়ায় সম্প্রতি সময়ে তিনি (ইসমাইল খান) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি’র বরাবরে ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা চালুর দাবিতে’ আবেদন করে সরাসরি দুইবার তার (মন্ত্রী) সাথে সাক্ষাত করেন। দুইবারই মন্ত্রী তার আবেদনের যাচাই করে জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করেন। মন্ত্রীর নির্দেশের পর গত দশ মাসেও মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাষ্ট থেকে তার বন্ধ ভাতা চালু করা হয়নি। এরইমধ্যে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য অভিযোগকারীদের পক্ষে স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খানের কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদাও দাবি করেছেন।

অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান উপায়অন্তুর না পেয়ে তার বন্ধ ভাতা চালু করার দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের স্ব-পক্ষের একমাত্র শক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি সাক্ষাত করার জন্য গত ২৬মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গিয়েছিলেন। ওইসময় রাষ্ট্রীয় কাজে প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় ইসমাইল খান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডাক গ্রহণ ও বিতরণ শাখায় প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে লেখা একটি আবেদন জমা দিয়ে আসেন। দীর্ঘদিনেও ওই আবেদনের সারা না পেয়ে গত ২৫ অক্টোবর তিনি (ইসমাইল খান) ডাকযোগে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে খোলা চিঠি প্রেরণ করেছেন। একইভাবে রাষ্ট্রপতি, স্বরাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর বরাবরেও খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান।

তার সকল কাগজপত্র পর্যালোচনাসহ যুদ্ধকালীন কমান্ডার, সহযোদ্ধা ও স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণ করে তার (ইসমাইল খান) সাময়িকভাবে বন্ধ ভাতা চালু করাসহ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত চান ’৭১ এর রণাঙ্গণ কাঁপানো অসহায় যুদ্ধাহত এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক এ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার শেষ ইচ্ছে কি পূরণ হবে। সে আশার প্রহর গুনছেন অসহায় যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল খান।