বরিশাল: মলা মাছে ভিটামিন ‘এ’ আছে। রাতকানা রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। মলা মাছের মাথায় ৫৩ ভাগ ভিটামিন থাকে। ৬টি মলামাছ যার ভর ১৭ গ্রাম, একটি শিশুর প্রতিদিনের পুষ্টির জোগান দেয়। আগে মলা মাছের উপকারীতা জানতাম না। জালে ধরা পড়লে ফেলে দিতাম। এখন মলা মাছের কেজি বিক্রি হয় তিন’শ টাকায়। মলা মাছ সম্পর্কে একটানা উল্লেখিত কথা বলে গেলেন বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের বাড়ৈখালী গ্রামের গীতা রানী নিত্তি (৫২)। মলা মাছ ধরার জন্য নারীদের উপযোগি জাল পাওয়াতে এখন তাদের খাদ্য তালিকায় মলা মাছের উপস্থিতি বেড়েছে বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ফিস বরিশাল অফিসের আমন্ত্রণে কার্যক্রমের এলাকা পরিদর্শণে গেলে প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন বর্ণনা করেন মলা মাছ নিয়ে কার্যক্রমের শুরুর দিকের কথা। বরিশালে ইউএসএইডে’র এআইএন প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে অক্টোর মাসে। ২০১২ সালে শুরুতেই মাঠে নামেন তারা। তখনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বরিশাল অঞ্চলের মানুষ মলা মাছকে মলান্দা মাছ নামে ডাকেন এবং গরীবের মাছ হিসেবে ভাবেন। এর পুষ্টিগুন সম্পর্কে অজ্ঞ বলে অবজ্ঞাই করেন সিংহভাগে। তবে ওয়ার্ল্ড ফিসের উত্তর বঙ্গের একটি মেলায় অংশ নিয়ে মলা মাছের গুনাগুন সম্পর্কে জানার অভিজ্ঞতা থেকেই এর চাষে উদ্বুদ্ধ করতে, নিজ থেকেই তাগিদ অনুভব করেন। প্রকল্পের কার্যক্রমে নেই বটে তবুও মলা মাছের চাষাবাদ নিয়ে প্রশিক্ষণ দেন চাষীদের। এরপর নিজেদের অর্থ দিয়ে কিনে অক্সিজেন ভর্তি পলিব্যাগ করে মলা মাছ বিতরণ করেন। শুরুতে ৫ থেকে ৬ হাজার পুকুরে মলা মছের চাষ হলেও এখন এই সংখ্যা বেড়ে ৩৪ হাজারে উন্নীত হয়েছে। এর চাষ নিয়ে জাকির হোসেন বলেন, বছরে ৩ থেকে ৪ বার বাচ্চা দেয় মলা মাছ। প্রতিদিন মলা মাছ ধরতে হবে।

 

নতুবা আপনা থেকেই লীন হয়ে যায় এই মাছ। চাষের বছরখানিক সময় পাড় হলে দেখতে পান মলা মাছ ধরা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তখন নারীদের জন্য ঝাকি জাল, ধর্মজাল বা ছাবি জাল দিয়ে ধরার পরামর্শ বাতলালেও মাছ পেতে বিলম্ব হওয়ায় ভাটা পড়ে। এরপর দেড় বছর ধরে মলা ধরার উপযোগি জাল নিয়ে তারা এক্সপেরিমেন্ট চালান। যার ধারাবাহিকতায় বছর খানেক হলো যুতসই জাল তৈরী করতে পেরেছেন তারা। গিলনেট নামক এইজাল ৪০ থেকে ৫০ ফুট লম্বা আর সাড়ে ৪ ফুট খাড়া হয়। ১২ ফুট পর কখনো পয়েন্ট ৭ কখনোবা পয়েন্ট ৬ ফাঁস দিয়ে জিরো সাইজের সূতা দিয়ে বুনন করতে হয়। এই জাল তৈরীতে উপকরণ বাবদ ৩’শ আর ২’শ টাকার মজুরি মিলিয়ে ৫’শ টাকায় বিক্রি হয়। শুরুতে তারা অর্ধেকটা সাবসিডি দিয়ে ১৫৫ টি মলা মাছ ধরার গিলনেট দিয়েছিলেন। যা এখন বাবুগঞ্জ, গৌরনদী ও নলছিটি উপজেলা মিলিয়ে ৩ শতাধিক ছুঁয়েছে। এই জাল দিয়ে সহজেই নারী নিজ সময় ও সুযোগমত পুকুরে পেতে টেনে তুলতে পারেন। এতে ১’শ মিনিটে ১৫ থেকে ২৫ টি মলা মাছ তোলা যায়। যা তরকারির সাথে দিয়ে রান্না করলে একটি পরিবারের এক বেলার জন্য যথেষ্ট। এই জালের চাহিদা এবং মলা মাছের বাজার দর বৃদ্ধি পাওয়াতে তিনি মনে করেন মানুষের মধ্যে মলা মাছ খেতে আগ্রহ বেড়েছে।
বাড়ৈখালি গ্রামের শান্তনা রানী বললেন, মলা মাছের মাথা তিতা লাগতো বলে কোটার সময় ফেলে দিতাম। তবে দলীয় সভার মাধ্যমে মাথায় ৫৩ ভাগ ভিটামিন থাকে একথা জানার পর মাথা ফেলা বাদ দিয়েছি। শিশুদের জন্য হাল্কা তেলে ভেজে নিয়ে ভর্তা করে খিচুরির সাথে খাওয়ানো হয়। নতুবা চচ্চড়ি করে বড়া বানিয়ে নেয়া যায়। মলা মাছের ঝোল বা পিঁয়াজ ভূনাও করা হয়। মলা মাছের আচাড় বানানো যায়। সবমিলিয়ে ৬ থেকে ৭ ভাবে মলা মাছ রান্না করতে পারেন তারা। ওয়ার্ল্ড ফিসের নিউট্রেশন এন্ড একুয়াকালচার স্পেশালিস্ট মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া জানান, কেবল ভিটামিন ‘এ’ নয়; মলা মাছে জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে। এতে করে রাতকানা রোগ প্রতিরোধের সাথে অনান্য পুষ্টির জোগান দিয়ে থাকে। তাই এই মাছ গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য খুবই উপযোগি। একথা শুনে পাশে থাকা মতিলাল হাওলাদার বলেন,মলা মাছে চোখের জ্যোতিও বাড়ায়। সপ্তাহে গড়ে ৩ দিন তারা মলা মাছ খেয়ে থাকেন। এই মাছের গুনাগুন জানতে পাওয়ায় দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।