বাংলাদেশের মাটিতে তার জন্ম হয়নি। নেই রক্তের কোনো বন্ধন। তবুও এ দেশের মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিক মিস লুসি হল্ট। সাদা চামড়ার ভিনদেশি এ মানুষটি ৫৬ বছর ধরে বাংলাদেশে আছেন । পূর্বসূরী ব্রিটিশ শাসকদের দুঃশাসন নিয়েও রয়েছে তার চরম ক্ষোভ। মহান মুক্তিযুদ্ধের নিভৃতচারী নিরব সাক্ষী এ মানুষটি যুদ্ধাহত মানুষদের সেবা দিয়েছেন। কিন্তু গ্রহণ করেননি স্বীকৃতি পত্র। এখন শুধু তার চাওয়া ব্রিটেনের পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব কিংবা প্রতিবছর ভিসা নবায়নের ফি মওকুফ করার। এ বিদেশিনী মরতেও চান এ দেশের মাটিতে। এ জন্য তিনি বরিশালে কবরের স্থানও নির্ধারণ করে রেখেছেন।
বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনের হাসপাতালের সেবায়েত হিসেবে কাজ করার জন্য ১৯৬০ সালে লুসি নিজের জন্মস্থান ছেড়ে এখানে আসেন। দু’ বছর বাদে এ মিশন ছেড়ে তার দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু এখানকার প্রকৃতি, আর মানুষের ভালোবাসার অদৃশ্য বন্ধনে তিনি জড়িয়ে পড়েন। গত ৫৬ বছর ধরে চলছে তার লাল-সবুজের দেশের সাথে মিতালি। তার হূদয় জুড়ে এখন শুধুই বাংলাদেশ। ভালো লাগা আর ভালোবাসা থেকেই রপ্ত করেছে বাঙালিয়ানা পুরোপুরি। চলনে-বলনে সবকিছুতেই তার প্রমাণ মেলে।
বেশ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারদর্শী লুসি জানান, একাত্তরের স্মৃতি রয়েছে তার চোখজুড়ে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বেশ কয়েক মাস আয়া হয়ে যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে আহতদের সেবা দিয়েছেন। আহতদের সেবা দেওয়ার অবদান হিসেবে সনদ গ্রহণ করেননি তিনি। পাকিস্তানি শাসনের মতই ক্ষোভ রয়েছে তার ব্রিটিশ শাসকের শাসন-শোষণ নিয়ে। তার মতে, ব্রিটিশরা এখানে (এ উপমহাদেশে) সঠিক শাসন করেনি। পূর্বসূরীদের দুঃশাসন নিয়ে কেউ কিছু বললে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে বোবামুখে তিনি কষ্ট দেন নিজেকে। বলেন, “ওরা অপরাধ করছে। ভুল করেছিল অনেক। ওদের পাপের কারণেই আমি উত্তরসূরী হিসাবে প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে কষ্টকে গ্রহণ করি। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডের সেন্ট হেলেন শহরে মিস লুচি হল্টের জন্ম। দেশ ছেড়ে আসার সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছর। এখন প্রায় ৮৬ বছরের বৃদ্ধা তিনি।
বাংলাদেশের মানুষের প্রতিও তার ক্ষোভ রয়েছে। তিনি জানান, বাঙালিরা নিজ দেশের চেয়ে বিদেশিদের বেশি প্রশংসা করে। এটা ঠিক নয়। তিনি বলেন, “বাংলাদেশিরা নিজেরা নিজেদের পেছন লেগে থাকে। তাদের বোকার মত আচরণ আমাকে কষ্ট দেয়। আমি চাই এদেশের মানুষ একে অপরকে ভালোবাসবে, প্রশংসা করবে। বিদেশিরা নয়, এ দেশিরাই তাদের আপন। ”
লন্ডনি কন্যা লুসি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে গত চার দশক তার কেটেছে বিনে পয়সায় সেলাই শেখানো, তাঁত প্রশিক্ষণ, পথশিশুদের পাঠদান, আবার কখনো হাসপাতালে সেবা প্রদান করে। এ কাজে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। কাজের শুরুটা বরিশাল থেকে হলেও পর্যায়ক্রমে নওগাঁ, রাজশাহী, যশোর, ঢাকা, গোপালগঞ্জ ও খুলনা হয়ে আবারো সেই বরিশালে। নিজের জন্মস্থান, পরিবার-পরিজন, ব্রিটিশ আভিজাত্য ফেলে এ বিদেশিনী একা থাকেন অক্সফোর্ড মিশন হোস্টেলের ছোট্ট একটি কক্ষে। কেউ তার কাছে আসেন ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের জন্য। আবার কেউবা বাংলা থেকে ইংরেজি করাতে।
এ অনুবাদের কাজে তার নামমাত্র উপার্জন হয়। ব্রিটিশ নগরিক হিসাবে ৭০ পাউন্ড মাসিক ভাতা পান। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই ৬ হাজার টাকাই তার আয়। তাও আবার আসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দেন বলে জানান অক্সফোর্ড মিশনের ম্যানেজার বেনিডিক্ট বিমল ব্যাপারী। বিমল ব্যাপারী আরো জানান, দীর্ঘ বছর ধরেই লুসিকে চেনেন তিনি। সাদাসিধে নিঃস্ব এ মানুষটির বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটাই দাবি তাকে দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রদানসহ বছরে ভিসা নবায়নের ৩৮ হাজার টাকা যেন মওকুফ করে দেওয়া হয়।