ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট ১০৮ রানে জেতার পর বাংলাদেশকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ঠোঁট কাটা ইংলিশ ভদ্রলোক জিওফ বয়কট। তিনি বলেছিলেন, ‘এই যে ঘরের মাঠে বাংলাদেশ জিতছে সেটা বিদেশের মাটিতে করে দেখাক।’ তার কথার সারমর্ম, বিদেশের মাটিতে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল জিতলেই তিনি বাংলাদেশকে বড় দল মানতে রাজি! বয়কটের এই কথা তো ছিলই সঙ্গে গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ দলের ধারাবাহিক সাফল্যে অনেকে স্বপ্ন আঁকতে শুরু করেছিলেন, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে যা এতদিন হয়নি এবার বুঝি হবে।

যারা স্বপ্ন আঁকছিলেন আপাতত তাদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হচ্ছে। যে নিউজিল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ২০১০ ও ২০১৩ সালে দুটি সিরিজে বাংলাওয়াশের লজ্জা দিয়েছে সাকিব-মাশরাফিরা তাদের কাছে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা পেতে হল। অনেকে বলবেন, নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে মানিয়ে নেয়াটা বেশ কঠিন। উপমহাদেশের দলগুলোর সেখানে ভালো করাটা বেশ কষ্ট সাধ্যের। কিন্তু ক্রাইস্টচার্চ আর নেলসনে যে তিনটি ম্যাচ খেলল বাংলাদেশ, তাতে বাংলাদেশের হারের পেছনে কন্ডিশনকে খুব একটা দায়ি করা যাচ্ছে না।

প্রথম ম্যাচে বোলাররা উদারহস্তে রান দিলেন। ফলে নিউজিল্যান্ড শুরুতেই ম্যাচটিকে ধরাছোঁয়ার  বাইরে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় ম্যাচে রান চেজ করতে গিয়ে মাঝবিরতি পর্যন্ত মনে হচ্ছিল, ম্যাচে অনায়স জয়ই পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তারপর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন আপ। এই রোগ অনেক দিন দেখা যায়নি। কোত্থেকে জানি সেটা আবার নেলসনে আবির্ভূত হল! শেষ ম্যাচে আগে ব্যাট করে যেখানে ২৮০ বা তারও বেশি রান করার সম্ভাবনা ছিল সেখানে ২৩৬ রান তুলে বাংলাদেশ হেরেছে ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে।

সফর শুরুর আগে নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনের কথা মাথায় রেখে সিডনিতে নয় দিনের ক্যাম্প করেছে বাংলাদেশ। এই ক্যাম্প করার জন্য নাকি বিসিবির খরচই হয়েছে ১ কোটি টাকা! মজার ব্যাপার হল, ওয়ানডে সিরিজে নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন বাংলাদেশকে যে খুব বেশি ভুগিয়েছে তা কিন্ত না। কারণ স্বয়ং অধিনায়কই বলেছেন, ‘ উইকেট দেশের মতই।’ তারপরও বাংলাদেশ গত দুই বছর ধরে যে ফরম্যাটে আধিপত্য দেখিয়ে আসছে সেই ওয়ানডেতে কিছু করে দেখাতে পারল না।

তৃতীয় ওয়ানডের কথাই ধরা যাক, ইমরুল কায়েস-তামিম ইকবাল ওপেনিং জুটিতে তুলে ফেললেন ১০২ রান। এরকম শুরু করার পরও বাংলাদেশ যে ২৩৬ এর বেশি তুলতে পারল না সেটা তো ব্যাটসম্যানদের নিদারুন ব্যর্থতায়। আর স্যাক্সটন ওভালের ছোট মাঠে ব্যাটসম্যানরা সেট হয়ে গেলে আটকানো কঠিন। বাংলাদেশ দলও পারেনি। প্রথম ওয়ানডেতে বোলারদের ব্যর্থতায় ৩৪১ এর জবাবে ২৬৪ কে ইতিবাচকই ধরা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে মোক্ষম সুযোগ পেয়েও বাংলাদেশ ম্যাচটি ফেলে দিল! ইমরুল কায়েস ও সাব্বির রহমান দুজন যেভাবে একই প্রান্তে দৌড় দিলেন নিকট অতিতে এরকম ঘটনা দেখা যায়নি। তারা দুজন যখন ব্যাট করছিলেন তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি ম্যাচটি বাংলাদেশ হারতে পারেন। কিন্তু ওই ভুতুড়ে রান আউটের পরই সব কিছুতে তালগোল পেকে গেল। ফল যা হওয়ার তাই হল। জয়ের পরিবর্তে ৬৭  রানের পরাজয়।

তাছাড়া ওয়ানডে সিরিজে অতিরিক্ত পরীক্ষা-নীরিক্ষাও বাংলাদেশকে ভুগিয়েছে। সৌম্য সরকারের বিকল্প হিসেবে দ্বিতীয় ম্যাচে ওয়ানডে ক্যাপ তানভির হায়দারের মাথায় পড়িয়ে দেয়া হল। ঘরোয়া ক্রিকেটে তানভিরের পরিচয় লেগ স্পিনার ও মিডল অর্ডারের মোটামুটি ব্যাট চালাতে পারেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি প্রস্তুতি ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়ে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের নজরে পড়েছিলেন তানভির। তারপরই তাকে নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। যেহেতু লেগ স্পিনার নেই দলে তাই তাকে নিতে হবে। এই খোড়া যুক্তিতে সাদামাটা মোটামুটি মানের এক অলরাউন্ডারকে বিবেচনা করা হল সৌম্যর বিকল্প হিসেবে। তাতে লাভটা কি হল?

হাথুরুসিংহের সামনেই আছেন মুমিনুল হক-মেহেদি হাসান মিরাজ। মুমিনুল সদ্য শেষ হওয়া বিপিএলে রাজশাহী কিংসের হয়ে কি করেছেন তা সবার জানা। তারপরও মুমিনুলকে চোখে পড়ে না হাথুরুর! ওই যে তার গায়ে টেস্ট বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের তকমা লেগে গেছে! অথচ নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে রয়েসয়ে খেলার জন্য সৌম্যর দারুন বিকল্প হতে পারতেন মুমিনুল। তা হলে হয়ত গত দুবছরের সাফল্যর ধারাবাহিকতা ২০১৬ সালের শেষেও বজায় থাকত। কথায় আছে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। বাংলাদেশ যে শেষটাই ভালো করতে পারল না!