যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমে কোর্টের বিচারপতি হিসেবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিল গোরসাচকে মনোনীত করার পর থেকে তাকে নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রয়াত বিচারপতি অ্যান্টোনিন স্কালিয়ার স্থলাভিষিক্ত হতে যাওয়া এই গোরসাচ কে? সুপ্রিম কোর্টে তিনি যুক্ত হয়ে আবারও রক্ষণশীলদের আধিপত্য ফিরিয়ে আনবে কিনা কিংবা গোরসাচের আদলে রক্ষণশীল স্কালিয়াই আবার ঘুরেফিরে আসছেন কিনা তা নিয়েও চলছে আলোচনা।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন নিল গোরসাচ। কলম্বিয়া, হার্ভার্ড এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করা গোরসাচ সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। বিচার বিভাগে নামমাত্র বেতনেও কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
২০০৬ সাল থেকে কলোরাডোর টেনথ সার্কিট কোর্ট অব আপিলস-এ কাজ করেছেন। মাছ ধরা, শিকার করা এবং স্কি করতে দেখা যায় তাকে। রক্ষণশীলদের আশা, প্রয়াত রক্ষণশীল বিচারপতি স্কালিয়ার যোগ্য উত্তরসূরী হবেন গোরসাচ।
গোরসাচের মা অ্যানি বুরফোর্ড গোরসাচ রিগ্যান প্রশাসনে এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি পরিচালনা করতেন। ১৯৮৩ সালে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় তাকে। দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তের মুখোমুখি করা হয়েছিল তাকে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন অ্যানি গোরসাচ।
১৯৮৪ সালে তেল কোম্পানি শেভরনকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রুল জারি করেছিল তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কারণে রক্ষণশীলরা গোরসাচকে পছন্দ করে থাকেন। ওই রুলে বলা হয়েছে, যেন আইন নিয়ে যেন ফেডারেল এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে মতামত বা ব্যাখ্যা জানতে চায়। গোরসাচের মতে, আইনের ব্যাখ্যা বিচারকরা দেবেন, ফেডারেল সংস্থাগুলো নয়।
মঙ্গলবার গোরসাচকে মনোনীত করেন ট্রাম্প
লিবারেলদের ঘোর বিরোধী গোরসাচ। ২০০৫ সালে কনজারভেটিভ ন্যাশনাল রিভিউ ম্যাগাজিনে আমেরিকান লিবারেলদের সমালোচনা করেছিলেন তিনি। তার মতে, আমেরিকান লিবারেলরা সমকামী বিবাহ থেকে শুরু করে আত্মহত্যায় সহায়তার মতো সামাজিক এজেন্ডাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে আদালতমুখী হয়। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি রাজ্যে মৃত্যুপ্রায় রোগীদের কষ্ট লাঘবের জন্য তাদেরকে জীবন শেষ করে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এর ঘোর বিরোধী গোরসাচ।

আর তাই গোরসাচের সঙ্গে স্কালিয়ার মিল থাকার প্রসঙ্গটিই ঘুরেফিরে আসছে। ১৯৮৬ সালে অ্যান্টোনিন স্ক্যালিয়াকে নিয়োগ দেন সেসময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান।১৯৩৬ সালে নিউজার্সির ট্রেনটনে জন্ম নেওয়া অ্যান্টোনিন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের হাইকোর্টে নিয়োজিত প্রথম ইতালীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। রক্ষণশীলদের আইনি দর্শন ‘মূলবাদ’ এর প্রবক্তাদের একজন ছিলেন তিনি। আর সে ধারণামতে অ্যান্টোনিন বিশ্বাস করতেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান বেশ অর্থবহ এবং সময়ের সাথে সাথে তা পরিবর্তন করার দরকার নেই।

২০০৮ সালে অ্যান্টোনিনের কলাম্বিয়ায় দেওয়া একটি মতামতের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র বহনকে ব্যক্তিগত অধিকার বলে অনুমোদন দেওয়া হয়। গর্ভপাত এবং সমকামীদের অধিকারের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অ্যান্টোনিন স্কালিয়া প্রয়াত হন। রক্ষণশীল অধ্যুষিত হাইকোর্ট বেঞ্চেরও একজন সদস্য ছিলেন অ্যান্টোনিন। তার মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের হাইকোর্টে রক্ষণশীল ও লিবারেলদের মধ্যে আবারও ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। স্কালিয়ার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাইকোর্টের ৯ সদস্যের বেঞ্চের ৫ জনই রক্ষণশীল ছিলেন। আর হাইকোর্ট বেঞ্চে রক্ষণশীলদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রশাসনের নেওয়া জলবায়ু ও অভিবাসনবিষয়ক বেশ কিছু পরিকল্পনা আটকে গিয়েছিল।তবে স্কালিয়ার মৃত্যুর পর রক্ষণশীল ও উদারবাদী বিচারপতির সংখ্যা ৪-৪ এ দাঁড়ায়। শিগগিরই কাউকে অ্যান্টোনিনের স্থলাভিষিক্ত করা হবে বলে সেসময় প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা দিলেও পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত অ্যান্টোনিনের জায়গাটি ফাঁকা রাখতে বলে রিপাবলিকানরা। পরে দশ মাসের জন্য নিয়োগ স্থগিত করা হয়। এবার স্কালিয়ার স্থলাভিষিক্ত করতে নিল গোরসাচকে বেছে নেওয়ার কথা জানালেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিল গোরসাচের নিয়োগ নিশ্চিত হলে সুপ্রিম কোর্টে আবারও রক্ষণশীলদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

গোরসাচ ও ট্রাম্প
মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর প্রতিবেদনে বলা হয়, স্কালিয়ার জায়গায় গোরসাচের নিয়োগ চূড়ান্ত হলে সুপ্রিম কোর্টের মতাদর্শিক ভারসাম্যের জায়গাটি যে দোদুল্যমান থাকবে তা নয়। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গোরসাচ অনেকটাই রক্ষণশীলদের হয়েই কাজ করবেন যেমনটা স্কালিয়া করতেন। কিন্তু মাত্র ৪৯ বছর বয়সী এ বিচারপতি নিয়োগ পেলে তিনি হবেন ২৫ বছরের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে কনিষ্ঠ বিচারপতি। আর তিনি দীর্ঘদিনের রক্ষণশীল শিরায় নতুন রক্তপ্রবাহ তৈরি করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা, চিন্তাধারায় স্কালিয়ার সঙ্গে মিল থাকলেও তিনি বিভেদ সৃষ্টিকারী বলে পরিচিত নন।

মঙ্গলবার সকালে হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুম থেকে নিল গোরসাচকে মনোনীত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। নির্বাচনি প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভাব্য বিচারপতি হিসেবে যে ২১ জনের নাম প্রকাশ করেছিলেন, গোরসাচ তাদেরই একজন। মনোনীত হিসেবে গোরসাচের নাম ঘোষণা করতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘বিচারপতি গোরসাচের অসাধারণ আইনি দক্ষতা রয়েছে, মেধাবী মনন রয়েছে, তিনি প্রচণ্ডরকমের নিয়মানুবর্তী এবং তিনি দল নিরপেক্ষ সমর্থন অর্জন করেছেন’।

মনোনয়ন গ্রহণ করতে গিয়ে প্রয়াত বিচারপতি স্কালিয়াকে স্মরণ করেন গোরসাচ। সুপ্রিম কোর্টের প্রয়াত বিচারপতি অ্যান্টোনিন স্কালিয়ার স্থলাভিষিক্ত করতে এ মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়া না হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে সিনেটের ওপর।