মাটি দিয়ে মাদ্রাসার ফ্লোর ঢালাই, ছাদ ঢালাই করা হয়েছে ৩ ইঞ্চি!
✪ বিশেষ প্রতিবেদক ☞ বরিশালের বাবুগঞ্জে প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা মূল্যের মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ কাজে প্রকৌশলীদের যোগসাজশে ছাদের পুরুত্ব ৫ ইঞ্চির পরিবর্তে ঢালাই করা হয়েছে ৩ ইঞ্চি! দেয়াল এবং ফ্লোরে ব্যবহার করা হয়েছে ৪ নম্বর পঁচা ইট! সিলেটের মোটা বালুর পরিবর্তে ঢালাইতে দেওয়া হয়েছে লোকাল বালু! অভিযোগের এখানেই শেষ নয়। এসব গুরুতর অনিয়মের পরে এবার খোয়ার সাথে মাদ্রাসার মাঠ গর্ত করে মাটি তুলে নিয়ে ভবনের ফ্লোর ঢালাই করার অভিযোগে ঠিকাদারকে হাতেনাতে আটক করেছে স্থানীয় জনতা। এসময় ওই ভবন নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা দুই প্রকৌশলীকেও ঘন্টাব্যাপী অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সোমবার বাবুগঞ্জ উপজেলা সদরে অবস্থিত খানপুরা আলীম মাদ্রাসায় এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৪ বছর আগে বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে ৭৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে খানপুরা আলীম মাদ্রাসার নতুন ভবন নির্মাণের কাজ পায় মেসার্স বুশরা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই নির্মাণকাজটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিনে নেন আবদুল মজিদ ও হারুন নামের দুই ঠিকাদার। সিডিউল নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরে তারা অত্যন্ত নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে কাজটি শুরু করলে স্থানীয়রা আপত্তি জানায়। পরে স্থানীয়দের চাঁদাবাজি মামলার ভয় দেখিয়ে কিছুদিন কাজ বন্ধ রাখেন ঠিকাদাররা। পরবর্তীতে নিম্নমানের রড, বালু সিমেন্ট এবং খোয়া দিয়েই তারা ভবন নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় খানপুরা গ্রামের বাসিন্দা ও জাতীয় পার্টির দপ্তর সম্পাদক মাসুদ পারভেজ বলেন, নির্মাণকাজের সিডিউলে ভবনের ছাদ ৫ ইঞ্চি ঢালাই করার কথা থাকলেও ঠিকাদার আবদুল মজিদ ও তার পার্টনার হারুন ৫ ইঞ্চির পরিবর্তে মাত্র ৩ ইঞ্চি ছাদ ঢালাই করেন। এছাড়াও অত্যন্ত নিম্নমানের ৪ নম্বর পঁচা ইট দিয়ে দেয়ালের গাঁথুনি এবং ফ্লোরের সলিং করেন। নামমাত্র সিমেন্ট দেওয়ায় হাত দিয়ে ধাক্কা দিলেই দেয়াল ধ্বসে পড়ে। তাদের এসব পুকুর চুরি যাতে কেউ দেখতে না পারে সেজন্য তারা সবসময় রাতের আঁধারে ঢালাই করেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে ক্ষমতার দাপটে উল্টো চাঁদাবাজি মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন তারা।
ছাত্রসমাজের রহমতপুর ইউনিয়ন শাখার সভাপতি রাকিবুল হাসান রাকিব জানান, ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে চুক্তি করে ঠিকাদাররা রাতের আঁধারে ৩ ইঞ্চি ছাদ ঢালাই দিয়েছেন। এরপরে গত শনিবার রাতে খোয়ার সাথে মাদ্রাসার মাঠ গর্ত করে মাটি কেটে নিয়ে একটি রুমের ফ্লোর ও বারান্দা ঢালাই করেন। সোমবার সকালে আরেকটা রুমের ফ্লোরে খোয়ার সাথে মাটি, গাছের শিকড় এবং সিলেট বালুর পরিবর্তে লোকাল বালু মিশিয়ে ঢালাই করার সময় ঠিকাদার আবদুল মজিদকে হাতেনাতে ধরে আটকে রাখা হয়। ঢালাইতে ব্যবহারের জন্য মাটি কেটে মাদ্রাসার মাঠকে একটা পুকুর বানিয়ে ফেলেছেন ঠিকাদাররা। খবর পেয়ে সাইটের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই ইঞ্জিনিয়ার আসলে উত্তেজিত এলাকাবাসী তাদেরকেও প্রিন্সিপালের রুমে অবরুদ্ধ করে রাখে।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে খানপুরা আলীম মাদ্রাসা অধ্যক্ষ মাওলানা আ.জ.ম শামসুল আলম আক্ষেপ করে বলেন, ঠিকাদাররা শুরু থেকেই ক্ষমতা দেখিয়ে সিডিউল বহির্ভূতভাবে অত্যন্ত নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা একাধিকবার অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছেন। তাদের এসব ঔদ্ধত্যের ঘটনা ইঞ্জিনিয়ারদের জানিয়েও কোন লাভ হয়নি। উল্টো আরও বেপরোয়া হয়ে গালি দিয়েছেন ঠিকাদার মজিদ। রাজনৈতিক শেল্টার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের যোগসাজশেই ঠিকাদাররা প্রকাশ্যে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছেন বলে জানান মাদ্রাসার অধ্যক্ষ।
অভিযোগ প্রসঙ্গে নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ আশিকুর রহমান বলেন, ‘খানপুরা আলীম মাদ্রাসা ভবনের ছাদ ঢালাইসহ অধিকাংশ নির্মাণকাজ আগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী নেপাল চন্দ্র ভুঁইয়া করে গেছেন। ঠিকাদারকে তিনি ৩৫ লাখ টাকার বিলও দিয়েছেন। তিনি বদলি হওয়ার পরে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে আমি এই কাজটি তদারকি করছি। ঠিকাদার আমাকে না জানিয়েই ফ্লোর ঢালাই দিচ্ছিলেন। তিনি একদিন আগেও নাকি রাতে একটা রুমের ফ্লোর ঢালাই দিয়েছেন। আমি আজ ফোনে ঘটনা জানতে পেরে সহকারী প্রকৌশলী স্যারকে নিয়ে ঘটনাস্থলে আসি। তবে এলাকাবাসী ভুল বুঝে আমাদের ওপরেও চড়াও হয়।’
বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মনিরুল কবির জানান, ঠিকাদাররা ফ্লোর ঢালাইসহ যেসব কাজ অফিসকে না জানিয়ে করেছেন সেসব কাজ ভেঙে আবার নতুন করে করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢালাইয়ের খোয়ার সাথে মাটি মিশ্রিত দেখা গেছে। তাই খোয়া, ইট এবং বালুসহ সকল নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী কাজের সাইট থেকে দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার জন্য ঠিকাদারকে চিঠি ইস্যু করা হবে। এই মাদ্রাসা ভবনে আর কোনো নিম্নমানের কাজ করার সুযোগ পাবেন না ঠিকাদার।
তবে প্রকৌশলীদের এসব আশ্বাসে আর বিশ্বাস করছেন না স্থানীয়রা। প্রায় একঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখার পরে ঠিকাদার আবদুল মজিদ এবং দুই প্রকৌশলীকে মুক্তি দিলেও তাদের বিচার দাবি করেছেন তারা। খানপুরা আলীম মাদ্রাসা নির্মাণকাজ বরিশাল জেলার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য নিম্নমানের কাজ দাবি করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে এই ঘটনা তদন্ত করে ঠিকাদার এবং প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এদিকে অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে অভিযুক্ত ঠিকাদার আবদুল মজিদ বলেন, ‘কাজটি করতে গিয়ে আমাদের অনেক লস হয়েছে। তাই কাজটা ৩-৪ বছর ধরে ফেলে রেখেছিলাম। সিডিউল মতো কাজ বাংলাদেশের কেউই করে না। অফিসে আমাদের পার্সেন্টেজের টাকা দেওয়া লাগে। তাই এর চেয়ে ভালো কাজ করা সম্ভব নয়।’