সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে প্রমত্তা পদ্মার স্রোত আর ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের প্রচেষ্টায় কাল (শনিবার) বসছে বরিশালবাসীর স্বপ্নের পদ্মাসেতুর প্রথম স্প্যান। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ দিন সকালে সরকারের পক্ষে এই ঐতিহাসিক দৃশ্যের সাক্ষী হবেন। জাজিরা পয়েন্টে পদ্মাসেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারেই বসছে প্রথম স্প্যান। যার ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। এই স্প্যানটিই ১৬ কোটি মানুষের সামনে স্বপ্নের পদ্মাসেতুর প্রথম দৃশ্যমান অংশ। ‘পদ্মাসেতু প্রকল্প’ পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের শুক্রবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সেতু প্রকল্প’ পরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, ‘মূল সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর বসবে পদ্মা সেতুর স্প্যান। যার ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। সে লক্ষ্যেই কাজ চলছে পদ্মার পাড়ে। প্রমত্তা পদ্মার প্রবল স্রোত ও ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে চলছে নির্মাণ যজ্ঞ। নদীর তলদেশে মাটির স্তরের গঠন নিয়ে জটিলতা কাটিয়ে বর্ষায় নদীর প্রবল স্রোতকে উপেক্ষা করে চলছে এ নির্মাণযজ্ঞ। এসব প্রতিকূলতা জয় করে মূল সেতুর পাইলিংয়ের কাজ চলছে পদ্মার দুই পাড়ে। জাজিরা অংশে সব পিলারের পাইলিংয়ের মাটি পরীক্ষার কাজও শেষ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।

পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ‘প্রথম স্প্যানটি অস্থায়ী বেয়ারিংয়ের ওপর বসানো হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তার কাছ থেকে সময় নিয়ে চূড়ান্ত হবে স্প্যান বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।’

প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘পদ্মাসেতুর রঙ হবে সোনালি। তবে রাতে সেতুটিতে জ্বলবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে লাল ও সবুজ বাতি। সেভাবেই সেট করা হবে বাতি। পদ্মা নদীর পানির স্তর থেকে ৫০ ফুট উঁচুতে বসবে প্রতিটি স্প্যান। কাজের গতি বাড়াতে সিঙ্গাপুর থেকে আরও ২টি হাইড্রোলিক হ্যামার আনা হয়েছে। এসেছেন নতুন পারদর্শী শ্রমিক ও নতুন দক্ষ প্রকৌশলী। মূল নদীর মধ্যে ১৫০ মিটার পর পর ৪২টি পিলারের প্রতিটি পিলারে ৬টি করে মোট ২৫২টি পাইল থাকছে। এর মধ্যে ২৮টি পাইলের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। ৫৮টি পাইলের কাজ শেষ হয়েছে ৫০ ভাগ। এই মুহূর্তে ৫টি স্প্যান বসানোর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। ইতোমধ্যেই প্রস্তুত করা স্প্যানের লোড টেস্ট করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পদ্মার দুই পাড়জুড়ে (মাওয়া ও জাজিরা) চলছে পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ। রোদ, বৃষ্টি ও স্রোত ও ঢেউকে বশ মানিয়ে দেশি-বিদেশি শ্রমিক-প্রকৌশলীরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই মহাযজ্ঞ। তদারকিতে যুক্ত রয়েছেন বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল। চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে এই সেতু দৃশ্যমাণ করতে স্প্যান বসানোর কথা থাকলেও বিভিন্ন টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) উঠছে সেই স্প্যান, যার ওপর দিয়ে চলবে গাড়ি।

সরকারের নীতি নির্ধারকরা জানিয়েছেন, এই মূহূর্তে সরকারের লক্ষ্য একটাই, আর তা হলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া। পদ্মাসেতু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদীগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পদ্মা অন্যতম। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু প্রকল্প অংশে পদ্মা আরও তীব্র খরস্রোতা। গত ৩০ জুনের মধ্যে স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা ছিল। তবে সম্প্রতি বন্যা, তীব্র স্রোত আর কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে তা হয়নি।

প্রকল্প পরিচালক জানান, প্রবল বৃষ্টি, নদীতে পানির প্রবল স্রোতকে সামাল দিয়ে চালাতে হয়েছে কাজ। এক সেকেন্ডের জন্যও বন্ধ রাখা হয়নি এ সেতুর নির্মাণ কাজ। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মার অন্যপ্রান্ত জাজিরা পয়েন্টে চলছে পাইল ড্রাইভ, মাওয়া পারে ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে চলছে স্টিলের কাঠামো ও স্প্যান জোড়া দেওয়ার কাজ। দেখা গেছে, মাওয়া চৌরাস্তার দক্ষিণে বিস্তৃত প্রকল্প এলাকার ট্রান্স ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে চলছে প্রায় তিন হাজার টনের (২ হাজার ৯শ টন) একেকটি স্প্যান তৈরির কাজ।

সেতু প্রকল্পের প্রকৌশলীরা জানান, সেতুর মোট ৪২টি পিলারের মধ্যে এখন কাজ চলছে ১৯টির। পিলার বসবে পাইলের ওপর। পদ্মা সেতুতে মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তে ২১টি ও জাজিরা প্রান্তে ২১টি। এসব পিলারের ওপরই বসানো হবে এক একটি স্প্যান। স্প্যানের ওপর ঢালাই দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য উপযোগী করা হবে।

সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, জাজিরা প্রান্তে ৩৭ নম্বর থেকে শুরু হবে স্প্যান বসানোর কাজ। এরপর একে একে পাতা হবে ৪২ নম্বর পিলার পর্যন্ত। সেখানে এখন চলছে কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজ। নির্মাণাধীন পিলারগুলোর ওপর প্রথম দফায় কমপক্ষে পাঁচটি স্প্যান (স্টিলের কাঠামো) বসানোর প্রস্তুতি চলছে।

এদিকে কাজের গতি বাড়াতে অতিরিক্ত আরও দু’টি হাইড্রোলিক হ্যামারসহ অতিরিক্ত জনবল প্রকৌশলী আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, ‘নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে এ সেতুর কাজ শেষ করার। আমরা সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি। একেকটি হ্যামারের ক্ষমতা দুই হাজার ৪০০ কিলোজুল।