বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) জাহাজ নিয়ে ঘটছে অদ্ভুত কাণ্ড। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলের জন্য সংস্থার এমভি বাঙালি ও এমভি মধুমতি জাহাজ লিজ চেয়ে আবেদন করেছে আট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। দরপত্র আহ্বান ছাড়াই তারা মনগড়া দরপ্রস্তাব করেছে। যদিও এ রুটে রোহিঙ্গা ইস্যুুতে বর্তমানে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এ বিষয়ে আট প্রস্তাবের মধ্যে ৬টিতেই লিখিত সুপারিশ যুক্ত করেছেন আবেদনকারীরা। এগুলোর সুপারিশ রয়েছে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের। এ পরিস্থিতিতে করণীয় জানতে চেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিআইডব্লিউটিসি।

যদিও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, এ ধরনের চিঠি অবশ্য তার নজরে আসেনি। বিষয়টি অবগত হলে তখন বলতে পারব কী করণীয়।

নৌ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. আব্দুস সামাদ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ওই পর্যটন রুটে বর্তমানে এমনিতেই নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিকল্প পথে জাহাজ চালানোর ব্যাপারে কথাবার্তা হচ্ছে। তাই এ রুটে অনুমতির বিষয়টি খতিয়ে দেখার আছে। আর দরপত্র আহ্বান ছাড়া প্রস্তাব পাঠানো এবং এর বাস্তব প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ ছাড়া কোনো মন্তব্য করা যাবে না।

তাছাড়া বিআইডব্লিউটিসির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটের ৩৪ কিলোমিটারের মধ্যে ১০ কিলোমিটারই সমুদ্র এবং বাকি ২৪ কিলোমিটার নাফ নদী। জাহাজ দুটির সমুদ্রে চলাচলের অনুমতি নেই। অপরদিকে ওই রুটে যাত্রী নিরাপত্তাজনিত কারণে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া টেন্ডার ছাড়া স্বপ্রণোদিত হয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ইজারার আবেদন সরাসরি নাকচ করার ক্ষমতা রয়েছে সংস্থাটির।

ওই ক্ষমতা প্রয়োগ না করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়ে চিঠি দিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে।

বিআইডব্লিউটিসি থেকে নৌ সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে- টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে এমভি বাঙালি/মধুমতি নৌযান চালাতে টেন্ডার আহ্বান না করার পরেও আট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় আগ্রহী হয়ে দর প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে বে অব বেঙ্গল টুরিজম ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দর প্রস্তাব করে। মজিবুর রহমান জয় নামের একজন দর প্রস্তাব করেছেন ১৫ লাখ টাকা।

আর জহির উদ্দিন প্রস্তাব করেছেন ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মেসার্স হাকিম ট্রেডার্স অ্যান্ড ট্যুরিজম দর প্রস্তাব করেছে ১৪ লাখ টাকা। মেসার্স সি গাল ক্রুজ লাইনের দর প্রস্তাব ১৪ লাখ টাকা। আবার মেসার্স গোল অ্যান্ড অ্যাডভারটাইজিং প্রস্তাব করেছে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ১২ লাখ টাকা প্রস্তাব করেছে মেসার্স লগ ট্রেডিং। আর ১৩ লাখ টাকা প্রস্তাব রয়েছে মেসার্স কিং টুরিজমের। অবশ্য তাদের দর প্রস্তাবে লিখিত সুপারিশ নেই।

দরপত্র আহ্বান ছাড়াই স্বেচ্ছায় দর প্রস্তাব এবং সুপারিশের বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসির এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রত্যেকের ব্যাপারেই মন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পরীক্ষা করে বা বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নিতে। তাই এটি মন্ত্রী বা এমপির সুপারিশ হিসেবে ধরা যাবে না।

মূলত রাজনীতিবিদদের কাছে কেউ গেলে এ রকম ‘রিকমান্ড’ করা হয়। আর দরপত্র ছাড়া জাহাজ লিজের প্রস্তাবে করণীয় জানতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সূত্রমতে- এমভি বাঙালি’ ও ‘এমভি মধুমতি’ জাহাজ দুটি অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা-বরিশাল-মোরেলগঞ্জ (বাগেরহাট) রুটে যাত্রী বহন করছে। এছাড়া জাহাজ দুটি অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর আওতায় রেজিস্ট্রেশন করা। আইনগতভাবে এ জাহাজটি সমুদ্রপথে চলতে হলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়, যা জাহাজটির নেই।

বিআইডব্লিউটিসির লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে- টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌযান পরিচালনার বিষয়ে ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন অধিদপ্তর বিআইডব্লিউটিসিকে চিঠি দেয়। তাতে বলা হয়েছে- নৌমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কোস্টাল ক্লাসভুক্ত যাত্রীবাহী জাহাজ ছাড়া অভ্যন্তরীণ যাত্রীবাহী জাহাজকে বে ক্রসিং (সমুদ্রপথে) চলাচলের অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এ কারণে এমভি বাঙালি নৌযানের উপকূল অতিক্রমের অনুমতির বিষয়টি বিবেচনা করেনি নৌ অধিদপ্তর।

একই চিঠিতে গত বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা থাকায় বিশেষ বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু এ বছরে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে না আসায় বিবেচনার সুযোগ নেই মর্মে চিঠিতে উল্লেখ করে নৌ অধিদপ্তর।

তা ছাড়া বিআইডব্লিউটিসির এমভি বাঙালি জাহাজটি গত বছর টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে ২ মাস ১৫ দিন চলাচল করে। এই অল্প সময়ে চলার মধ্যেই জাহাজের তলদেশের প্লেটে শামুক ও মেরিন ফয়েল জমা হয়। তা সরাতে দুই বার হাইস্পিড ডকইয়ার্ডে ওঠানো হয়।

পরবর্তীতে শামুক পরিষ্কার হলেও কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য গঠিত কমিটি একাধিক ত্রুটি চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিয়েছে। যদিও এটি করার কথা চার্টার গ্রহীতা বে অব বেঙ্গল টুরিজমের।

চিঠিতে আরও বলা হয়, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটের স্থল অংশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। এ নিয়ে কোস্টগার্ডের চিঠিতে বলা হয়েছে- সম্প্রতি টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে বাংলাদেশী বোটকে লক্ষ্য করে কয়েকবার গুলিবর্ষণ করে মিয়ানমাররের বিজিপি।

এতে নৌকার মাঝিসহ আরোহীরা আহত হন। এমনকি বোট আটক করে নিয়ে যায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

এ পরিস্থিতিতে নিষিদ্ধ থাকা জাহাজ ইজারা চাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়েছে বিআইডব্লিউটিসি। তবে এ ধরনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে না পাঠিয়ে নিজেরাই নাকচ করে দিতে পারত সংস্থাটি।’’