নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী আগামী ৮ মে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। তবে মনোনয়ন দাখিলের আগেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালানোর অভিযোগ উঠেছে চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহামুদুল হক খান মামুনের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সরকারি স্কুল শিক্ষকদের ইফতার অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে তার অংশগ্রহণ এ প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। তার ওপর সেই অনুষ্ঠানেই প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা শিক্ষা অফিসার নিজেই।

সাধারণ শিক্ষকরা বলছেন, ‘ভোটকেন্দ্রে পোলিং অফিসের দায়িত্ব পালন করে থাকেন মাধ্যমিক বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেই শিক্ষকদের সঙ্গে প্রার্থীর উপস্থিতি এবং গণসংযোগ ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।

এমনকি, তফসিল ঘোষণার পর শিক্ষকদের অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যান প্রার্থীর উপস্থিতি অযৌক্তিক এবং বিধি পরিপন্থী বলে জানিয়েছেন বরিশাল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, ‘লিখিত অভিযোগ পেলে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

তবে ইফতার অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যান প্রার্থী খান মামুনের উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত বলে দাবি করেছেন অনুষ্ঠানের আয়োজক বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ এস-১২০৪৮ বরিশাল মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম পলিন্স। আমন্ত্রণ ছাড়াই যুবলীগ নেতা খান মামুন অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়েছেন বলে দাবি এই শিক্ষক নেতার। যদিও শিক্ষক সংগঠনের সাথে যুক্ত কয়েকটি সূত্রের দাবি, চেয়ারম্যান প্রার্থী খান মামুনের টাকায় ওই ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া কয়েকটি ছবিতে দেখা যায়, ‘বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ’ আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহামুদুল হক খান মামুন। একই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন বরিশাল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ আক্তারুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোস্তফা কামাল, উপজেলা শিক্ষা অফিসার ফয়সল জামিল, সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আনিসুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এন এ সিদ্দিকী রবিউল।সংগঠনের মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম পলিন্স’র ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা ছবিগুলোতে ‘খান মামুনকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া মহানগরের ব্যানারে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সদর উপজেলার শিক্ষকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন বলে ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়েছে। একই ছবি পোস্ট করেছেন খান মামুন নিজেও।

জানা গেছে, গত ২৪ মার্চ নগরীর একে স্কুলে অনুষ্ঠিত হয় ইফতার অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ বরিশাল মহানগরের সভাপতি হাজেরা মমতাজ মিতু। সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম পলিন্স। সংগঠনের সভাপতি একে স্কুলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।

এদিকে, শিক্ষক নেতার পোস্ট করা ছবি নিয়ে সমালোচনা চলছে নেট দুনিয়ায়। ছবির মন্তব্য বক্সে তাহমিদ আহমেদ, রুবাইয়াত আক্তার, সানি হাসানসহ অনেকেই লিখেছেন ‘শিক্ষকরা কি পারে একজন প্রার্থীকে নিয়ে এভাবে ইফতার করতে? তাহলে তারা নিরপেক্ষ কোথায় থাকলো?’

অপর একজন লিখেছেন, ‘উপজেলা নির্বাচনকে প্রভাবিত করায় তীব্র নিন্দা জানাই।’ জান্নাতুল নিলা নামে একজন লিখেছেন, ‘শিক্ষকরা জাতির মেরুদণ্ড, তারা এভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে না।’ মারিয়া হাসান নামের একজন উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীর চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করেছেন। জান্নাত রাইসা নামের একজন লিখেছেন ‘খান মামুন টাকা দিয়া সব কিনা নিছে।’ তামান্না আক্তার লিখেছেন, ‘জাতির মেরুদণ্ড যখন খান মামুনের মেরুদণ্ড।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ এস-১২০৪৮ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও বরিশাল মহানগরের সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম পলিন্স বলেন, ‘আমাদের যে আয়োজনটি করা হয়েছে, সেই ব্যানারে চেয়ারম্যান প্রার্থী খান মামুনের নাম নেই। তাকে এই অনুষ্ঠানে কে এবং কেন আমন্ত্রণ করেছে সেটাও আমার জানা নেই। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়লে তো তাকে বের করে দেওয়া যায় না।’

তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠানে আমরা কোন প্রার্থীকে সমর্থন এমনকি রাজনৈতিক আলোচনাও হয়নি। এখন কেউ যদি নিজে থেকে এসে বাইরে গিয়ে সমর্থনের অপপ্রচার করে সেটার দায়ভার তাকে নিতে হবে। এমনকি কারোর সহযোগিতায় নয়, শিক্ষকদের নিজেদের টাকায় ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে বরিশাল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘ইফতার অনুষ্ঠানে এমন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি বা প্রার্থী থাকবে জানলে আমি সেখানে যেতাম না। আমি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পর একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম ওই ব্যক্তির বিষয়ে। সে আমাকে জানিয়েছে, ওই ব্যক্তি (খান মামুন) রাজনীতি করে। তবে সেখানে আমি কোন রাজনৈতিক আলোচনা করিনি।

তিনি বলেন, ‘শিক্ষকরা নির্বাচনকালীন কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে ক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার পর কোন প্রার্থীকে নিয়ে সরকারি শিক্ষকদের এমন আয়োজন মোটেই কাম্য নয়। এটা যারা করেছে তারা অপরাধ করেছে। এ বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

তবে এ বিষয়ে বক্তব্য জানা যায়নি চেয়ারম্যান প্রার্থী মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহামুদুল হক খান মামুনের। তাকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

এদিকে, বরিশাল সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও আসন্ন নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহাবুবুর রহমান মধু বলেন, নির্বাচনে পোলিং অফিসারের দায়িত্বে থাকবেন সহকারী শিক্ষকরা। তফসিল ঘোষণার পর শিক্ষকদের নিয়ে একজন প্রার্থীর এমন কর্মকাণ্ড নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। যারা এই আয়োজন এবং অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন সেসব শিক্ষকদের নির্বাচনের দায়িত্ব না দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।

এদিকে, শিক্ষকদের এমন কর্মকাণ্ডের তুমুল সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল জেলার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান শাহীন।

তিনি বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকরা নির্বাচনে পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। সুতরাং তফসিল ঘোষণার পর কোনভাবেই তারা প্রার্থীকে নিয়ে এই কাজটি করতে পারে না। যারা এটি করেছে তারা অবশ্যই অপরাধ করেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’