নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পেটে গুলিবিদ্ধ হন একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. ইমন। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তিনি।
জানা যায়, ইমন টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের অর্জুনা গ্রামের মৃত মো. জুলহাস শেখের পুত্র। তিনি স্থানীয় মনিরুজ্জামান খান বিএম কলেজ থেকে ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। গত ৪ আগস্ট টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গোরাইতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন ইমন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রথমে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে এবং পরে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। সেখান থেকে একটি মাইক্রোতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে পুলিশ গাড়ি থামায়। পুলিশ যখন জানতে পারে রোগী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে, তখন পুলিশ সদস্যরা আহত ইমনকে গাড়ি থেকে জোর করে নামায়। তারপর লাথি মারে পেটে। পরে লাঠি দিয়ে বেদম পেটায়। শুধু ইমনকেই নয়, পুলিশ সদস্যরা গাড়ির চালকসহ সঙ্গীদেরও মারধর করে। পরে পুলিশের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করে ছাড়া পান তারা।
পুলিশ ছেড়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয় ইমনকে বহনকারী মাইক্রোবাসটি। তবে ভাগ্য ভালো এই সময়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স আসে। সেই অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়। তবে অ্যাম্বুলেন্সের চালক ঢাকা মেডিকেলে যেতে অস্বীকৃতি জানালে ইমনকে উত্তরার লেক ভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দুদিন রাখা হয়, দুদিনেই লাখ টাকা খরচ হয়। অনেক কষ্টে সে টাকা জোগাড় করে তার পরিবার। এরপর ৬ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে আইসিইউতে ভর্তি আছেন। চিকিৎসকরা স্বজনদের জানিয়েছেন, তার (ইমন) অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ ইমনের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে পারছে না তার পরিবার। হাসপাতালের মেঝেতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন ইমনের মা। বুক চাপড়ে সন্তানের জন্য করছেন আহাজারি।
জানা যায়, ক্লাস সিক্সে পড়াকালে ইমনের ভ্যানচালক বাবা মারা যান। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার চালিয়ে ছোটো তিন ভাইবোনকেও স্কুলে ভর্তি করায় ইমন। অত্যন্ত মেধাবী ইমন স্বপ্ন দেখতেন, একদিন সংসারের দুঃখ দূর করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন হাসপাতালের আইসিইউতে বন্দি। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না তার পরিবার।
ইমনের মা রিনা বেগম কান্না করতে করতে জানান, কি হতে কি হয়ে গেল। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেছিল আমার ইমন। পড়াশোনা আর সারাদিন টিউশনির পাশাপাশি ছোটো ভাইবোনগুলোকেও স্কুলে ভর্তি করায়। অনেক কষ্ট করত আমার সোনামনি। ওরে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলাম কিন্তু আমার কথা শোনেনি।
তিনি বলেন, আমাকে ফোনে একজন জানায় ইমনের গুলি লেগেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, আমি মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরলে ছুটে যাই হাসপাতালে। এখন আইসিইউতে ভর্তি আছে। এর-ওর কাছ থেকে টাকা ধার করে চিকিৎসা করাচ্ছি। ডাক্তার বলেছে, জ্ঞান ফিরলে পেটে অপারেশন করা লাগবে। অনেক টাকার প্রয়োজন, কি করব জানি না। আল্লাহ আমার এমন বিপদ দিল কেন, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ইমনের চাচাতো ভাই মো. নয়ন জানান, ইমন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে। টাকার অভাবে ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেনি। পরে স্থানীয় একটা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিল, কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে কি হবে আল্লাহ জানে।
তিনি বলেন, ওর বাবা মারা যায় ছোটো থাকতেই। টিউশনি করে কোনো মতে সংসার, নিজের পড়াশোনা আর ভাইবোনদের পড়াশোনা করাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট মির্জাপুরের গোরাইতে আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের গুলি ইমনের পেটে লেগে বেরিয়ে যায়। আমরা ওকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ গাড়ি থামিয়ে ইমনের পেটে লাথি মারে। পরে লাঠি দিয়ে পেটায়। এ সময় আমাকে আর গাড়ির চালককে মারধর করে। অনেক কাকুতি-মিনতি করে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়া পাই।
তিনি আরও বলেন, ওইদিন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ভয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছিল না। পরে উপায় না পেয়ে ঢাকার উত্তরার লেক ভিউ হাসপাতালে ভর্তি করি। দু’দিনেই এক লাখ টাকা বিল আসে। অনেক কষ্টে ওর মা টাকা জোগাড় করে, পরে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করাই। অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসকরা আইসিইউতে ভর্তি করে।
এ সময় ইমনের চিকিৎসায় সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।’