নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা:: দেশে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয় গত বছর। এ জন্য হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ খরচ করে প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এটি থেকে সরে আসার ঘোষণাও দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষাবিদরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তা অন্য কোনো শিক্ষাক্রমে প্রয়োগ সম্ভব নয়। ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য দেওয়া প্রশিক্ষণ আর কোনো কাজেই আসবে না। এ খাতে খরচ করা পুরো অর্থই জলে যাবে। সবচেয়ে বেশি গচ্চা যাবে প্রশিক্ষণে ব্যয় হওয়া অর্থ।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাই নতুন শিক্ষাক্রমের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তার তেমন একটা কার্যকারিতা থাকবে না। আর নতুন শিক্ষাক্রম ও এর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়েছে। এটা যে কার্যকরী কিছু ছিল, তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই মোটা দাগে বলা যায়, এ প্রশিক্ষণের পুরো টাকাটাই অপচয় হলো। এ জন্য সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা নিয়ে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি।
একই সুরে কথা বলেছেন জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন থেকে সরে এসে পুরোনো শিক্ষাক্রম (জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২) অনুযায়ী মূল্যায়নের কথা জানিয়েছে। বাস্তবতা হলো নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে পুরোনো শিক্ষাক্রমের কোনো মিল নেই। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ খাতে খরচ করা পুরো অর্থই গচ্চা যাবে। আর সবচেয়ে বেশি গচ্চা যাবে প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ করা অর্থ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত ‘ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিম’ প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রেণিশিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, প্রশিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তাদের অনলাইন ও সরাসরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) ‘চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’ প্রকল্পের আওতায় শ্রেণিশিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, প্রশিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়।
মাউশি সূত্র বলছে, ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিম প্রকল্পের আওতায় মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫ লাখের বেশি শিক্ষককে সরাসরি ও অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে ৮২৯ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে খরচ হয় ২৫৪ কোটি ২৪ লাখ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৭৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তবে চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) এখনো কোনো প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়নি, তাই কোনো অর্থও খরচ হয়নি।
জানতে চাইলে ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিম প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী গণমাধ্যম কে জানান, আপাতত নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ বন্ধ রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সূত্র বলছে, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকল্পের আওতায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩ লাখ ৯২ হাজার শিক্ষককে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আর সশরীরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষককে। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খরচ হয় ১৯৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) নতুন শিক্ষাক্রমের কোনো প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়নি। আপাতত আর কোনো প্রশিক্ষণ আয়োজন না করার সম্ভাবনাও নেই। তবে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি ডিপিই মহাপরিচালক মো. আব্দুস সামাদ।
২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। আর চলতি বছর বাস্তবায়ন করা হয় দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। পরীক্ষামূলকভাবে এসব শ্রেণিতে প্রণয়ন করা হয়েছে পাঠ্যবই। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছর চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেণিতেই তা চালুর কথা ছিল। এরপর ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হওয়ার কথা ছিল নতুন শিক্ষাক্রমে।
তবে এ শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষকদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ ছিল। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ছিল এর মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে। কারণ, এ শিক্ষাক্রমে প্রথাগত পরীক্ষাপদ্ধতি ছিল না। এ অবস্থায় নানা সমস্যা তুলে ধরে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২-এর বিষয়ে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তথা অংশীজনদের অভিমত, গবেষণা ও জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠ্য বিষয়বস্তু ও মূল্যায়নপদ্ধতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা, নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রকট অভাব ও নানাবিধ বাস্তব সমস্যা বিদ্যমান থাকায় এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে প্রতীয়মান।’
সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শিক্ষাক্রম প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ৪ সেপ্টেম্বর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণও হয়েছে নতুন নিয়মে। এখন আমরা যদি আবার আগের (জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২) শিক্ষাক্রমে ফিরে যাই, তাহলে সেই শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণই প্রযোজ্য হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ এ ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না।’ তিনি আরও বলেন, কোনো প্রশিক্ষণই সম্পূর্ণ অকাজে যায় না। তবে দেখতে হবে, কী বিষয়ে কেন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে? এর বর্তমান প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?