বরগুনা : সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে সনু নামে এক শিশুকে ভারতে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে দু’দেশের বেশ কিছু মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় তোলে বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার গ্রামর্দন গ্রামের জামাল ইবনে মুসা। বেশ কিছু মিডিয়ায় তাকে মহান করে তুলতে বজরঙ্গি ভাইজান নামেও আখ্যা দিয়েছে। তবে তার এ বজরঙ্গি ভাইজানের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভিন্ন জামাল। ডাকাতি, জাল টাকার ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণসহ বহু অপরাধের নায়কও সে।

শিশু সনুকে ভারতে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার পিছনেও কোনো মহত্ত্ব নয় বরং প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। বেতাগী উপজেলার গ্রামর্দন গ্রামটিতে সরেজমিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে জামাল ইবনে মুসার বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।

সৌদি নাগরিক মুসা মক্কির ছেলে জামাল ইবনে মুসা। শুধু বরগুনার বেতাগীর গ্রামর্দন নয়, বাংলাদেশেই তার পৈত্রিক কোনো সম্পত্তি নেই। নানার বাড়ি বাংলাদেশে হওয়ায় এখানে থাকতে শুরু করে সে। আর্টিসান প্রোপ্রাইটি নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৬ বছর কাজ করেছে বলে দাবি করে সে। তবে গ্রামবাসীর কাছে পাওয়া গেছে তার ভিন্ন পেশার নাম। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখ, বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ও অ্যাসিড বোমসহ ডাকাতি করতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়। অস্ত্র আইনে বামনা থানায় মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। ৫ বছর সাজা খেটে মুক্তি পায় জামাল।

বিষখালী নদীতীরের বদনিখালী গ্রামের প্রতিবন্ধী জালাল মৃধা জানান, বিষখালী নদীতে জামালের নেতৃত্বে ডাকাতি চলতো তখন। গ্রামবাসী অতিষ্ঠ হওয়ায় সে সময়ের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মরহুম বাসারের নেতৃত্বে নদীতে ডাকাতিকালে আটক করে গ্রামবাসী। আর সেই নৌকার মধ্যে কাঠের পাটাতনের নিচে পাওয়া যায় ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র। এ মামলায় সাজা খেটে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কাঠের তৈরি বড় একটি ট্রলার ডাকাতি করে গ্রামে আনে সে। ট্রলারটি বিকল হলে স্থানীয় অতুল মিস্ত্রিকে খবর দেয় মেরামতের জন্য। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় ট্রলারসহ আত্মগোপন করে জামাল।

কয়েক বছর পরে আবারো গ্রামে ফেরে জামাল। শুরু করে জাল টাকার ব্যবসা। ২০১৩ সালের একটি জালটাকার মামলায় পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই তৌহিদুজ্জামান তার প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘জামাল ওরফে সৌদি জামাল, ওরফে ডাকাত জামাল, ওরফে প্রতারক জামাল, ওরফে জালনোট জামাল নামে গ্রামে পরিচিত সে। মামলার আসামি আবু কালামকে ফাঁসাতেই জামাল তার পকেটে জাল টাকা ঢুকিয়ে দিয়েছিল।’

শুধু আবু কালাম নয়, গ্রামের বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানি শুরু করে সে। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাকেও হয়রানি করতো।

এসবের চেয়ে আরো ভয়ংকর ঘটনা আছে এই জামালের জীবনে। নিজের মেয়ে ও শাশুড়িকে ধর্ষণের অপরাধে সেন্টু নামে এক ব্যক্তির ৬৪ বছরের কারাদণ্ড হলে তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর নাটক করে জামাল। সেন্টুর স্ত্রীর সরলতার সুযোগ নেয় সে। কৌশলে তাকে দিয়ে আদালতের মাধ্যমে সকল সম্পত্তি নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা করে।

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২২ তারিখে অনুষ্ঠিত নিলামে অংশগ্রহণ করে জামাল ও জামালের ভাই দুলাল। কৌশলে ০.৩৫২৫ একর জমি মাত্র এক লাখ টাকায় কিনে নেয় জামাল। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় সেন্টুর স্ত্রী বেবী বেগমের সঙ্গে। বিচারের দাবিতে ৮ জনকে সাক্ষী রেখে র‌্যাব-৮ এর কাছে অভিযোগ করে বেবী। ৮ জন সাক্ষীর মধ্যে একজন হাসি বেগম। সাক্ষীদের অনেকেই জামালের ভয়ে সাক্ষী দিতে রাজি হয়নি। তবে পিছপা দেননি হাসি বেগম। এতে হাসি বেগমের ওপর ক্ষিপ্ত হয় জামাল।

গ্রামর্দন গ্রামের সেই বেবী বেগম জানান, লম্পট স্বামীর কারাদণ্ডে তারা খুশি হলেও উপর্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় দারিদ্রতা নেমে আসে তার পরিবারে। তখন জামালের পরামর্শে সম্মত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় ও নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করলে বেশি অর্থ পাবার আসায় রাজি হয় সে। কিন্তু নিলামের মাধ্যমেই যে জামাল তাকে ঠকিয়ে কমদামে সব সম্পত্তি কিনে নেবে সেটা বুঝতে পারেনি সে।

এখন প্রশ্ন এমন চরিত্রের মানুষ জামাল তাহলে কী কারণেই বা সনুকে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে ভারত পর্যন্ত ছুটে গেলেন। নাকি সেখানেও কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। ঠিক তাই। বেবীর পক্ষে সাক্ষী দিতে রাজি হওয়ায় হাসিকে হয়রানি করতে উঠে পরে লাগেন জামাল।

তবে জামাল কীভাবে হাসিকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে সেটা জানার আগে এটা জানা দরকার যে ভারতীয় শিশু সনু কীভাবে হাসির কাছে এসেছে। কে এই হাসি? জামালের কথা অনুযায়ী হাসি কি সত্যিই মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত? নাকি প্রতারক ও ডাকাত জামালের সাজানো নাটক এটি।

গ্রামর্দন গ্রামে মরহুম নজরুল ইসলামের মেয়ে হাসি। ১৯৯৩ সালে ৭ কন্যা সন্তান রেখে মারা যান তিনি। বোনদের মধ্যে হাসি সবার বড়। নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে ৭ মেয়েকে নিয়ে চরম দারিদ্রতার শিকার হন হাসির মা চন্দ্র বানু। ৩ বছরের মাথায় খালাতো ভাই ইসলাম শেখ মিন্টুর সঙ্গে বিয়ে হয় হাসির। কিন্তু পরিবারে অন্য বোনদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে অনিহা প্রকাশ করে সে।

তার কথা অনুযায়ী, কাজের সন্ধানে অবৈধ পথে ১৯৯৭ সালে স্বামীর সঙ্গে মা ও বোনদের নিয়ে ভারতে যায় হাসি। কিন্তু সেখানে তাদের ফেলে পালিয়ে যায় হাসির স্বামী মিন্টু। পেটের ক্ষুধায় ভিক্ষা শুরু করে তারা। কয়েক মাস পরে একটি প্লাস্টিক ভাঙ্গার কারখানায় ৪০ টাকা মজুরিতে তিন বোন কাজ নেয়। পরে কারখানার মালিক জাহাঙ্গীর ব্যাপারীর সঙ্গে বিয়ে হয় তার বোন ফাতেমার। এরপরে ভারতের নাগরিক ও অবৈধভাবে যারা ভারতে থাকতো তাদের সঙ্গে অন্য বোনদেরও বিয়ে হয়। তাদের মধ্যে ৫ম বোন রহিমার বিয়ে হয় ভারতীয় নাগরিক মেহবু নামে এক গেরেজ মালিকের সঙ্গে। কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরলে ২০০১ সালে বাংলাদেশে আসে তারা।

এ হলো হাসির পরিবারের দারিদ্রতা জয়ের গল্প। তবে ভারতীয় শিশু সনু বাংলাদেশে আসলো কীভাবে আর কেন বাংলাদেশে এসেছে সে।

গ্রামে কাজের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বড় বোন হাসি ও তাদের মা চন্দ্র বানুর কাছে অন্য বোনদের সন্তানদের রেখে আবারো ভারতে চলে যায় বাকি ৬ বোন। কয়েক বছর পরে মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে বাংলাদেশে আসে ৫ম বোন রহিমা। আর তার ঘরে কাজের জন্য ও স্বামীকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্য কাজের লোক হিসেবে রেখে আসেন সনুর মা মাধবিকে (বর্তমান নাম মমতাজ)। অবৈধভাবে সীমান্ত পার না হতে পারায় প্রায় এক বছরের বেশি বাংলাদেশে থাকতে হয় তাকে।

রহিমা বাংলাদেশে থাকাকালীন স্বামী মেহেবু কাজের মেয়ে সনুর মা মাধুবির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পরে। মাধবীর গর্ভে মেহেবুর সন্তান আসে। বাধ্য হয়ে মাধবিকে হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলিম বানিয়ে মমতাজ নাম দিয়ে বিয়ে করে মেহেবু। প্রায় এক বছর পরে স্বামীর কাছে ফিরে এই পরিণতি দেখে অবাক হয় রহিমা। মেহেবুর পরিবারে শিশু সুনকে রেখে আত্মগোপন করে মাধবি। কাজের সুবিধার্থে নিজেদের সন্তানদের যেখানে দেশে রেখে গেছেন সেখানে অন্যের সন্তান বাধা হয়ে দাঁড়ায় রহিমার জন্য। তাই ২০১০ সালে জামালের শালা জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে সনুকে বাংলাদেশে তার বোন হাসির কাছে পাঠায় রহিমা।

এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে ভারতে থাকা রহিমার সঙ্গে কথা বললে কান্নায় ভেঙে পরে সে। বাংলামেইলকে জানান, সতিনের প্রথম স্বামীর সন্তানকে পাচার বা বিক্রির উদ্দেশ্য থাকলে ভারতেই করতে পারতেন তিনি। মা পালিয়ে যাওয়ার পরে সনুকে তাড়িয়েও দিতে পারতো সে। শিশু বয়সে এতিম ও দারিদ্রতার কষ্ট বুঝতে পেরে নিজের সন্তানকে যেখানে রেখে লালন পালন করছেন সেখানে পাঠিয়েছিলেন তিনি।

এ বিষয়ে কথা বলা হয় বড় বোন হাসির সাথে। হাসি জানান, সনু তার পরিবারের একজন সদস্য হিসেবেই ছিল। মা মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করায় ও মুসলিম পরিবারের সদস্য হিসেবে বড় হওয়ায় তার সুন্নতে খৎনাও করান হাসি। হিন্দু নাম সনুর পরিবর্তে তার নতুন নাম দেয়া হয় আমিন। অন্য বোনদের সন্তানদের যেমন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেছেন সনুকেও তিনি ভর্তি করেছিলেন গ্রামের গ্রামর্দন হাচানিয়া দাখিল মাদরাসায়।

গ্রামের সেই মাদরাসাটিতে গেলে হাসির কথার সত্যতা পাওয়া যায়। মাদরাসার প্রধান শিক্ষক বাংলামেইলকে জানান, বর্তমানে ভারতে চলে যাওয়া ওই শিশু আমিন মাদরাসার প্রথম শ্রেণিতে ২০১২ সালে ভর্তি করেছিলেন হাসি বেগম। সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যের বই দেয়া হয়েছিল তাকে। দুষ্ট প্রকৃতির হওয়ায় ঠিকমতো ক্লাস করত না সে।

যে শিশুকে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করতো হাসি, সে শিশু হাসির বিরুদ্ধেই বা কেন পাচারের অভিযোগ আনল। সে প্রশ্নের উত্তর মেলে আরো অনুসন্ধানে।

হাসিকে ফাঁসানোর উপায় খুঁজতে থাকা জামাল সনুর কাছ থেকে জানতে পারে বাংলাদেশে শিশু সনু রহিমার ছেলে ও আমিন নামে বড় হলেও তারা মায়ের নাম মাধুরি ও সে হিন্দু পরিবারের সন্তান ছিল। ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর মিষ্টি খাওয়ানোর কথা বলে শিশু সনুকে অপহরণ করে জামাল। প্রায় ২২ দিন ঢাকার মিরপুরে আটকে রেখে ভয়-ভীতি দেখিয়ে আদালতে হাসির বিরুদ্ধে মিথ্যা জবানবনবন্দি দেয়ায়। আদালত শিশু সনুকে যশোর সেইভ হোমে পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে প্রায় ৪ মাস পরে আবারো আদালতে সনুকে হাজির করা হলে বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা। বিচারকের সামনে জামালের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন শিশু সনু।

বরগুনা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. আব্বাস উদ্দিনের সামনে এ বছর এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে দেয়া জবানবন্দিতে সনু জানায়, মিষ্টি খাওয়ানোর কথা বলে জামাল প্রথমে তাকে বরগুনা ও পরে সেখান থেকে ঢাকার মিরপুর নিয়ে যায়। সেখানে অস্র দেখিয়ে ও বিভিন্ন ভয়-ভীতি দেখিয়ে হাসি ও হাসির বোনদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বাধ্য করেছিল জামাল। তাই অপহরণের পরে জামাল তাকে আদালতে হাজির করালে মিথ্যে কথা বলেছিল সে।

এদিকে, শিশু সনুকে খুঁজে না পেয়ে অপহরণের ৭ দিন পরে বেতাগী থানায় নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন হাসি বেগম। শিশু সনুকে পাচার করে আনলে সে শিশুকে ফিরে পেতে আইনের আশ্রয় নিতেন না। এমনটাই দাবি হাসি বেগমের।

 

ঘটনাক্রমে এলাকায় সন্ত্রাসী নামে পরিচিত জামাল আজ সারাদেশে আলোচিত মহামানব ‘ভজরঙ্গি ভাইজান’। অপরদিকে সতীনের ছেলেকে রাস্তায় ফেলে না দিয়ে সন্তানের মতো বড় করতে গিয়ে মানব পাচারকারী মাথায় নিতে হয়েছে হাসি ও তার বোনদের।

এ বিষয়ে কথা বলা হয় জামাল ইবনে মুসার সঙ্গে। শিশু সনুর বিষয়ে জানতে চাইলে অন্য মিডিয়াতে দেয়া বক্তব্য আবারো দেয়া শুরু করে জামাল। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও অপকর্মের বিষয় তুলতেই রেগে জান জামাল। বলেন, ‘অনেক বড় বড় সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া তাকে নিয়ে কাজ করছে। তাদের থেকে বেশি বোঝাটা আপনার ঠিক হবে না। আপনাকে না, প্রয়োজনে আপনার মিডিয়া প্রধানকে তথ্য ও বক্তব্য দেব।’

জামাল ইবনে মুসার সম্পর্কে বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে একাধিক থানায় নানা অপকর্মের মামলা আছে এবং বিভিন্ন সময় সে দোষী প্রমাণিত হয়েছে। তবে মানব পাচারের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।