আরিফ আহমেদ মুন্না চুয়াত্তরে পা দিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ফেলে আসা তেহাত্তর বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে দিশেহারা ও বহুধাবিভক্ত দলের শেষ আশ্রয়স্থল হন শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক প্রতিকূল স্রোতে শক্ত হাতে ধরেন নৌকার হাল।

এ পর্যন্ত উনিশবার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তাঁকে সরাসরি হত্যার চেষ্টা করা হয়। তবে সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় প্রত্যেকবারই তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরেন। মৃত্যুশঙ্কা পায়ে ঠেলে, বহু ঝড়ঝাপটা সামলে, বিপদসংকুল সমুদ্র পেরিয়ে বারবার নৌকাকে সফলতার সঙ্গে তীরে ভিড়িয়েছেন এই কাণ্ডারি। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন দলে পরম নির্ভরতার প্রতীক। শুধু দল নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও দেখিয়েছেন বহু চমকপ্রদ সাফল্য। অর্জন করেছেন অর্ধশতাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, পুরস্কার ও সম্মাননা। নিজেকে নিয়ে গেছেন বিশ্বের মধ্যে অনন্য এক উচ্চতায়।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মধুমতী নদীবিধৌত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর জন্ম। সেখানেই শৈশব-কৈশোর কাটে। বাংলার মাটির নিবিড় সংস্পর্শে বেড়ে ওঠার কারণেই পরবর্তী সময়ে এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর যোগসূত্র তৈরি হয়।

শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবনের শুরু টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকায় টিকাটুলীর নারী শিক্ষা মন্দিরে (শেরে বাংলা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ) ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ওই কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্রসংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। কলেজজীবন শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬৮ সালে বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় শেখ হাসিনার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী একদল সেনা সদস্য যখন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে, তখন শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা জার্মানিতে ছিলেন ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাসায়। মা-বাবাসহ স্বজনদের হারিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার এক অবর্ণনীয় দুঃসহ জীবন শুরু হয়। নানা দেশ ঘুরে তাঁদের আশ্রয় মেলে প্রতিবেশী দেশ ভারতে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে যায় আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি হয়ে পড়ে বিভক্ত। এই বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ওই বছরই তিনি তৎকালীন শাসকদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন দলের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁকে দলের অভ্যন্তরেও নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়।

নিজের বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার বলে শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে দলের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আবারও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। মাঝে একবার বিরতি দিয়ে ২০০৯ সালে আবারও প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত টানা তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে। এ দেশে এখন পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এই পদে রয়েছেন এবং হ্যাটট্রিক করেছেন। তবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার এই অঙ্গনটি শেখ হাসিনার জন্য কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বারবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। ১৯ বার তিনি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বর্বরোচিত হামলাটি হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।

একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনার অবদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এরই মধ্যে তিনি শান্তি, গণতন্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নয়ন এবং দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ভূষিত হয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ অসংখ্য পদক, পুরস্কার আর স্বীকৃতিতে। মহাশূন্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপরে সেতু নির্মাণ, পায়রায় গভীর সমুদ্রে স্থলবন্দর নির্মাণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রকল্প গ্রহণ করে তিনি আজ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাছেই অপার বিস্ময়ের এক নাম। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার শেখ হাসিনা।

মিয়ানমার সরকারের ভয়াবহ নির্যাতনে আশ্রয়হীন ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করে বিশ্ব মানবতার বিবেক হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন শেখ হাসিনা। পেয়েছেন ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’ উপাধিও। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁর উপস্থিতিতেই বিশ্বনেতারা শেখ হাসিনার এই মানবিক দৃষ্টান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা, সাহসী পদক্ষেপ ও মানবিক গুণাবলি তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে। সারা পৃথিবীর কাছে শেখ হাসিনা হয়েছেন মানবতার নেত্রী, হয়েছেন অপার বিস্ময়ের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। #

লেখাঃ আরিফ আহমেদ মুন্না
(সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও মানবাধিকার কর্মী)
প্রতিবেদক, দৈনিক সমকাল ও দি নিউ নেশন।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বিমানবন্দর প্রেসক্লাব।
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, বরিশাল বিভাগীয় কমিটি।
উপজেলা সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
আহবায়ক, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ, বাবুগঞ্জ উপজেলা কমিটি।
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।