ঝালকাঠির রাজাপুর-কাঠালিয়া আসনের সংসদ সদস্য বজলুল হক (বিএইচ) হারুনের ছেলে মাহির হারুনের মাধ্যমেই ‘দি রেইনট্রি হোটেল’র ৭০১ ও ৭০২ নম্বর রুম বুক করেছিল ‘ধর্ষক’ সাফাত। মাহির ওই হোটেলের ডিরেক্টরদের একজন এবং তারা বাবা ঝালকাঠী-১ আসনের এমপি হারুনই রেইনট্রির মালিক।

চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য দিয়েছেন সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে- মাহিরই রেইনট্রি হোটেলের রুম বুকিংসহ সার্বিক বিষয় তদারকি করে। আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ সঙ্গে মাহিরের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। তারা এক সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা (আইএসডি) নামের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করেছে।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় সাফাত প্রায়ই পার্টি করতে মাহিরের হোটেলে যেত। এমনকি দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের দিনও মাহিরের মাধ্যমেই রুমগুলো বুক করেছিল সাফাত। শুধু তাই নয় ওই রাতে সাফাতদের সঙ্গে দেখা করার জন্য একবার রুমেও গিয়েছিল মাহির।

সাফাতের সাবেক স্ত্রী ও ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীর ধারণা, ওই দিনের পুরো ঘটনাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। আর সে কারণেই হয়তো ঘটনার সময় এতো চিৎকার চেঁচামেচির পরও হোটেলের সব স্টাফ নীরব ভূমিকায় ছিল। মোটা অঙ্কের বখশিশ পাওয়ায় স্টাফরা কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। পাওয়া যায়নি ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরাতে ধারণ করা সেদিনের ভিডিও।

ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে হোটেল কর্তৃপক্ষের রহস্যজনক আচরণও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। শুরু থেকেই তারা পুলিশ ও সাংবাদিকদের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিচ্ছে। তারা কখনও বলছে, ধর্ষকরা দুটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছিল। আবার বলছে হোটেলের কোন কক্ষ তারা ভাড়া নিয়েছে, সেটি তাদের রেজিস্ট্রারে নথিভুক্ত করা নেই।

সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, এমপিপুত্র মাহিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তার হোটেলে প্রায়ই বন্ধ্,ু বান্ধবী ও নামি মডেলদের নিয়ে আড্ডা জমাতেন সাফাত। আরেক ধর্ষক নাঈম বিভিন্ন মডেলদের সেখানে ডেকে নিতেন। তারপর রাতভর মদ্যপান ও ইয়াবা সেবন করতেন, হই-হুল্লোড় করতেন।

তিনি আরও জানান, ঘটনার দিনও সাফাতের জন্য হোটেলের ৭০১ ও ৭০২ নম্বর রুম বুক করা হয়। শুধু তাই নয় জন্মদিন উপলক্ষে সাফাতের জন্য একটি কেকও উপহার দেয় মাহির। জন্মদিনের আগে ওরা সবাইকে বলেছিল উদযাপন করতে বন্ধুরা মিলে সিলেটে যাবে। একটা ক্রাইম করবে বলেই হয়তো সবাইকে মিথ্যা বলেছিল।

পিয়াসা সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাকে বিয়ে করার পর আমি জানতে পারি সে নিয়মিত ইয়াবা সেবন করে। এর আগেও বিয়ে করেছে, বেশিদিন তার কাউকে ভাল লাগে না। বিভিন্ন মডেলের সাথে ওর শারিরীক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু আমি তখন এগুলোকে পাত্তা দেইনি।’

সাবেক এই সংবাদ পাঠিকা আরও বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে দুই তরুণীকে ধর্ষণের পর সাফাতের অপকর্ম আড়াল করতেই তার বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম এখন আমাকে জড়িয়ে নানা কথা বলছেন। আজকে তিনি কেন স্টেটমেন্ট দিচ্ছেন, ক্রিমিনালরা কোথায়? তারা কেন স্টেটমেন্ট দিচ্ছে না? মা-বাপ কি জানেনা তার ছেলেরা কোথায়? বাবা যদি ছেলেকে উৎসাহ দেয় তাহলে এমন ঘটনা ঘটবেই।’

মাহির হারুন সম্পর্কে রেইনট্রি হোটেলের এক্সিকিউটিভ ইন্টারনাল অপারেশন (ইআইও) ফারজান আরা রিমির কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘হ্যাঁ মাহির হারুন আমাদের হোটেলের ডিরেক্টরদের মধ্যে একজন। তবে ঘটনার দিন তিনি হোটেলে ছিলেন কিনা তা মনে করতে পারছি না। সিসিটিভি ফুটেজও নেই, তাই কোনভাবেই এ তথ্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।’

সিসিটিভি ফুটেজ কেন নেই জানতে চাইলে রিমি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ আমরা এক মাসের জন্য সরবরাহ করি। এটা ইউএনডিএসের সার্টিফিকেট অনুযায়ী। আন্তর্জাতিক ওই নির্দেশনা অনুযায়ী একমাসের বেশি আমাদের কাছে কোনো ফুটেজ থাকে না।’

অভিযোগের ব্যাপারে মাহিরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশ: দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগে সত্যতা পেয়েছে পুলিশ। বুধবার (১০ মে) এক বিবৃতির মাধ্যমে এমন তথ্যই জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। মামলা নিতে দেরি হওয়ার কারণও ওই বিবৃতিতে স্পষ্ট করেন তিনি।

ডিএমপি কমিশনার বলেন, গত ৪ মে বাদী বনানী থানায় উপস্থিত হয়ে তাকে গত ২৮ মার্চ দিবাগত রাতে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর অপরাধের অভিযোগ ৩৭ দিন পর থানাকে অবহিত করায় ঘটনার সত্যতা ও বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এতে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের আলোকে মামলা করতে দেরি হওয়ার কারণ এবং ঘটনাটির বাস্তবতা ও সত্যতা সম্পর্কে প্রাথমিক তদন্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বনানী থানার পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়ায় ৬ মে মামলা নেয়।

তিনি আরো বলেন, মামলা হওয়ার পরপর থানার পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ ছায়াতদন্ত শুরু করে। বাদীর ইচ্ছা অনুযায়ী মামলাটি উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগে দেওয়া হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ, অপরাধ বিভাগ ও উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সমন্বয়ের মাধ্যমে আসামিদের গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে।

সেদিন যা ঘটেছিল দ্য রেইন ট্রি হোটেলে: গত ২৮ মার্চ দ্য রেইন ট্রি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে আমন্ত্রণ করে ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। গেলো শনিবার রাতে ভুক্তভোগীদের একজন বনানী থানায় আসামিদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে। সাফাত ও সাদমান ছাড়াও ওই মামলার অন্য আসামিরা হলেন- নাঈম আশরাফ (৩০), সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল (২৬) ও অজ্ঞাতনামা দেহরক্ষী।

মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী তরুণীদের একজন উল্লেখ করেছেন, ‘আসামিরা ২৮ মার্চ ৯টা হতে পরের দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত বনানীর দ্য রেইন ট্রি’ হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে আমাকে, আমার বান্ধবী এবং এক বন্ধুকে আটকে রেখে সবাইকে মারধর করে।  অস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে অশ্লীল গালিগালাজ করে।’

‘আমাকে ও আমার বান্ধবীকে রুমের মধ্যে জোরপূর্বক নেশাজাতীয় মদ্যপান করে আমাকে এক নম্বর আসামি এবং আমার বান্ধবীকে দুই নম্বর আসামি জোরপূর্বক একাধিকবার ধর্ষণ করে।’

‘তিন নম্বর আসামি সাকিফকে দুইবছর ধরে চিনি। তার মাধ্যমে এক নম্বর আসামির সঙ্গে পরিচিত হই। গত ২৮ মার্চ তার জন্মদিন উপলক্ষে এক নম্বর আসামির গাড়িচালক ও দেহরক্ষীকে পাঠিয়ে আমাদেরকে নিকেতন হইতে বনানীর রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। ’

হোটেলে ছাদে বড় অনুষ্ঠান হবে বলে আমারদেরকে নেওয়া হয়েছিলো উল্লেখ করে ওই ছাত্রী এজাহারে বলেন, ‘যাওয়ার পর ওরা ছাড়া আর কোনো লোক দেখি নাই। পরবর্তীতে জোরপূর্বক ধর্ষণের সময় গাড়িচালককে ভিডিও করতে বলে সাফাত।’

‘ঘটনার প্রতিবাদের কথা বললে নাঈম আমাকে মারধর করে। পরবর্তীতে আমাদের বাসায় দেহরক্ষী পাঠিয়েছিলো আমাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য। এতে ভয় পেয়ে যাই এবং লোক লজ্জা ও মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে বন্ধু, আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলা করতে বিলম্ব হয়।’’