ঝালকাঠির নলছিটি থানার সেই বিতর্কিত অফিসার ইনচার্জ (ওসি) একেএম সুলতান মাহমুদকে অবশেষে বদলি করা হয়েছে। সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে নতুন ওসি মো. সাখাওয়াত হোসেনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে অনেকটা নীরবেই গভীর রাতে নলছিটি থানা ছেড়ে যান। ঝালকাঠি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) এম.এম মাহমুদ হাসান নলছিটি থানার ওসির বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তার এই বদলি খবরে উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করেছে। এলাকাবাসী ওই ওসির সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীরা জানান, ওসি সুলতান মাহমুদ গত ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল নলছিটি থানায় যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি এলাকার সাধারণ লোকজন ও ব্যবসায়িদের থানায় এনে বিভিন্ন মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ বাণিজ্যের মেতে উঠে ছিলেন। ঘুষ দিতে কেউ অপরাগতা প্রকাশ করলে তার ওপর চালান হত পাশবিক নির্যাতন। তার ভয়ে এলাকার কোনো মানুষ মুখ খুলতে সাহস পায়নি।

খোদ সরকার দলীয় নেতাকর্মীরাও বেপরোয়া এই ওসির হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সেবার পরিবর্তে থানাকে ঘুষ-বাণিজ্য আর গণহয়রানির আখড়ায় পরিণত করেন তিনি। এ সংক্রান্ত সংবাদ বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সাংবাদিকদের থানায় মেরে জেলে পাঠানোর দেখে নেয়ার হুমকিও দেন তিনি। ওসির এই লাগামহীন দুর্বৃত্তপনার কারণে হয়রানির শিকার হয়ে তার মেয়াদের শেষ দিকে সাধারণ জনগণ থানায় আসা বন্ধ করে দেন বলেও জানান স্থানীয়রা।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত বছরের ২২ অক্টোবর কথিত ইভটিজিংয়ের অভিযোগে ছাব্বির হোসেন ও ইমরান মোল্লা নামের দুই শিশু শিক্ষার্থীকে দিনভর থানায় আটকে অমানুষিক নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে ওসি সুলতানের বিরুদ্ধে। তাদেরকে সকাল থেকে পানি বা কোনও ধরনের খাবার খেতে না দিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত থানাহাজতে আটক রাখা হয়।

ছেলের অপরাধ জানতে চাইলে ছাব্বিরের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন গালাগাল করে থানা থেকে বের করে দেন ওসি। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় ছাব্বিরকে ছেড়ে দিলে ওই দিন রাতেই তাকে নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও শাস্তি দাবি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন জাহাঙ্গীর হোসেন।

চলতি বছরের ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবসে উপজেলার খাগড়াখানা মডেল হাইস্কুলে ওসি সুলতান মাহমুদের উপস্থিতিতে বার্ষিক বনভোজন, নাচ-গান ও র‌্যাফেল ড্র অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

গত ৩০ মার্চ দুপুরে উপজেলার তৌকাঠি গ্রামের জাহাঙ্গীর মোল্লার ছেলে জসিম মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ নলছিটি থানা পুলিশ। তাকে থানায় নিয়ে আসার পথে হ্যান্ডকাফসহ সে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার জের ধরে নলছিটি থানার চারজন এসআই ও দুইজন এএসআই’র নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ওই দিন রাতে (সাড়ে ১২টায়) তৌকাঠি গ্রামের সজিব হাওলাদারের বাড়িতে জসিম আশ্রয় নিতে পারে সন্দেহে অভিযান চালায়। জসিমকে ওই বাড়িতে না পেয়ে সজিবের ছোট ভাই রাজিবের হাতে গাঁজা ধরিয়ে দিয়ে তাকে আটক করে পুলিশ। বিনা কারণে ছেলে আটকের প্রতিবাদ করায় সজিবের মা সেলিনা বেগমকে (৫৫) মারধর করে পুলিশ।

বৃদ্ধ এ নারীকে পিটিয়ে ও লাথি মেরে আহত করে তার ছেলে রাজিবকে আটক করে থানায় নিয়ে আসার খবর পরদিন সকালে জানাজানি হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে কুলকাঠি ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে গত ৩১ মার্চ থানা ঘেরাও করে ওসিসহ অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের অপসারণের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে।

এ ঘটনায় নির্যাতিত যুবকের মা সেলিনা বেগম বাদি হয়ে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি দমন আইনর ৫(২) ধারায় ঝালকাঠির বিশেষ জজ আদালতে এ নালিশী মামলা দায়ের করেন।