বার্তা পরিবেশক, ভোলা:::: ভোলায় মেঘনা নদীতে ডুবে যাওয়া মাছ ধরা ট্রলার আম্মাজান-২ এর মালিক তোফায়েল মাঝির খামখেয়ালীতে অকালে ঝরে গেছে ১০ জনের প্রাণ।
তোফায়েল মাঝির কারণেই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলার ডুবে ১০ জেলে মারা গেছেন বলে দাবি করেছেন নিহতদের পরিবার।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে চাঁদপুর থেকে মাছ বিক্রি করে ছেড়ে আসার সময় অধিকাংশ জেলেই মাঝি তোফায়েলকে নিষেধ করেছেন। কিন্তু তিনি জেলেদের নিষেধের তোয়াক্কা না করেই জোরপূর্বক চরফ্যাশনের উদ্দেশ্যে ট্রলার ছেড়ে আসেন। যার ফলেই মেঘনা নদীর ভোলা-বরিশাল সীমান্তবর্তী এলাকা রুকুন্দীতে ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি ডুবে যায়।
নিহত জেলে মফিজের মা নুরজাহান বেগম অভিযোগ করেন, ট্রলারডুবির দিন রোববার সকালে মফিজ বাড়িতে ফোন দিয়ে জানায়- তারা চাঁদপুর থেকে চরফ্যাশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। এ সময় মা নুরজাহান বেগম মফিজকে ঝড়ের মধ্যে আসতে নিষেধ করেন।
তখন মফিজ তার মাকে বলেন, ‘মা আমরা তোফায়েল মাঝিরে প্রথমেই ট্রলার ছাড়তে না কইছি, কিন্তু সে আমাগো কথা হোনে না। উল্টা আমাগরে কয় তাড়াতাড়ি যায়া বেতুয়া ঘাডের তন বরফ লইতো হইব। এ ঝড়ে কিচ্চু হইব না।’ এটাই ছিল নুরজাহান বেগমের সঙ্গে ছেলে মফিজের শেষ কথা।
এরপর মফিজ তার ৪ বছর বয়সী ছেলে হা-মীমের সঙ্গে কথা বলেন, ছোট্ট ছেলে হা-মীমও তার বাবাকে ট্রলারে না এসে গাড়ি দিয়ে আসতে বলেছে।
নিহত জেলে কামালের মা বিবি হাজেরা একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, তোফায়েল মাঝির কারণে আজ আমার ছেলেকে হারাতে হয়েছে। এমনকি একবারের জন্যেও তোফায়েলের কোনো লোক আমাদেরকে দেখতেও আসেনি।
নিহত জেলে মো. হাসানের স্ত্রী মোসা. মরিয়ম বেগম জানান, ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের মধ্যে ট্রলারের সব জেলে নিষেধ করার পরও তোফায়েল মাঝি ট্রলার ছেড়ে আসায় আমার স্বামী মারা গেছে। গত ১০ বছর ধরে আমার স্বামী তোফায়েল মাঝির ট্রলারে কাজ করলেও লাশ উদ্ধারের পর থেকে এখনও তোফায়েল মাঝি বা তার কোনো লোকজন তাদেরকে দেখতে বা সান্ত্বনা দিতে আসেনি। তারা এ ঘটনায় তোফায়েল মাঝিকে দায়ী করে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া জেলে আমজাদ বলেন, গত ৩১ অক্টোবর চরফ্যাশনের আবদুল্লাহপুর ইউনিয়ন থেকে ২১ জেলে নিয়ে তারা গভীর সাগরে মাছ শিকারে যায়। মাছ শিকার শেষে গত ৮ নভেম্বর সাগর থেকে চাঁদপুরে মাছ বিক্রি করতে যায়। শনিবার চাঁদপুর অবস্থান করে রোববার সকালে চরফ্যাশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা।
তিনি বলেন, এ সময় চাঁদপুর থেকে অন্য নৌকার আরও তিন জেলে তাদের সঙ্গে আসে। পুরো পথ ভালোভাবে পাড়ি দিলেও বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভোলার ইলিশা পয়েন্টে আসলে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি উল্টে যায়। এ সময় আমি ট্রলারের কেবিনের মধ্যে আটকা পড়ি। অনেক কষ্ট করে সেখান থেকে বের হয়ে উল্টে যাওয়া ট্রলারের পিঠের উপর বসি। ট্রলারের পিঠে আমরা মোট ১৩ জন বসা ছিলাম। কিছুক্ষণ পর ট্রলারটি পুরোপুরি ডুবে গেলে আমরা সাঁতরে চরে উঠি। তবে ট্রলারের কেবিনে থাকা বাকী জেলেরা বের হতে পারেনি।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত তোফায়েল মাঝির বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়রা বলছেন তিনি ঘটনার পর থেকে গা-ডাকা দিয়েছে।
তোফায়েল মাঝির ভাই সামসুল হক মাঝি মোবাইলে জানান, জেলেরাই বাড়িতে আসার জন্য তাড়াহুড়ো করায় আমার ভাই বাধ্য হয়ে ঝড়ের মধ্যেই ট্রলার ছেড়ে এসেছেন।
ডুবে যাওয়া ট্রলারের মৃত জেলেরা হলেন মো. মফিজ মাতব্বর (৩৫), কামাল দালাল (৪০), মো. বিল্লাল (৩৫), হুমায়ুন কবির (৪০), নজরুল ইসলাম (৩৫), আব্বাস মুন্সি (৪০), রফিক বিশ্বাস (৫৫), হাসান মোল্লা (৩৮), নুরনবী বেপারী (৩০), খোরশেদ (৩৫)। এরা সবাই চরফ্যাশন উপজেলার দুলারহাট থানার বাসিন্দা।
জীবিত উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন তোফায়েল মাঝি, জামাল মাঝি, আমজাদ হোসেন, ছালাহউদ্দিন, মো. হোসেন, মো. আজাদ, কালু বিশ্বাস, ফয়সাল, জাকির হোসেন, হেজু, মো. নাসিম, মো. জসিম ও মো. শামিম।
এ ঘটনায় এখনও নিখোঁজ রয়েছে নাসিম নামের এক জেলে।
ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, ট্রলারডুবির ঘটনায় নিহত জেলেদের প্রত্যেক পরিবারকে তাৎক্ষনিক ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও তাদের মধ্যে যারা নিবন্ধিত জেলে রয়েছে তাদেরকে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে আরও এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে।
তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মৃধা মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটির গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি আগামী ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তারপর নিশ্চিত হওয়া যাবে এ ঘটনার জন্য কে দায়ী।
প্রসঙ্গত, গত রোববার দুপুরের দিকে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে চাঁদপুর থেকে ২৪ জেলে নিয়ে ছেড়ে আসা মাছ ধরার ট্রলার আম্মাজান-২ মেঘনা নদীতে ডুবে যায়। ওই দিন ১০ জেলেসহ ১৩ জন জীবিত ও এক জেলের লাশ উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। পরের দিন সোমবার রাতে ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে ৯ জেলের লাশ উদ্ধার করা হয়।