২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বরিশাল আওয়ামী লীগ বিএনপির রাজনীতিতে নিরব বিদ্রোহ

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:৩৫ অপরাহ্ণ, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বরিশাল আ’লীগ বিএনপির রাজনীতিতে নিরব বিদ্রোহ

  • অস্তিত্বহীন জামায়াত, ঘরকেন্দ্রিক জাতীয় পার্টি

নিজস্ব পরিবেশক, বরিশাল:: বরিশাল রাজনীতিতে ভিন্ন এক চিত্র ষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাইরে ঠিকঠাক মনে হলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঘরে ক্ষোভে তুষের আগুন জ্বলছে। সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে ঘিরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বড় অংশ একটি শক্ত বলয় তৈরি করতে সক্ষম হলেও স্বস্তি নেই। বরং দিনোত্তর বিভক্তির রেখা ষ্পষ্ট হয়ে উঠছে। দলের মধ্যে এক নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বঞ্চিত নেতাকর্মীরা সদর আসনের সাংসদ কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) জাহিদ ফারুক শামীমের দিকে ঝুকছে শুরু করেছেন। বর্ষিয়াণ এই নেতা ঐক্য ধরে রাখতে চাইলেও পরিস্থিতিগত কারণে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এখন জাহিদ ফারুকের বৃহস্পতি যেন তুঙ্গে। তার দিকেই ধাবিত হচ্ছেন নেতাকর্মীরা। অনুরুপ বিএনপির গৃহেও একই অবস্থা। পাঁচবারের নির্বাচিত সাংসদ এবং দলের যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার স্থানীয় নেতৃত্ব নিজের হাতে ধরতে চাইলেও ক্রমশই নেতাকর্মী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সংগঠনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে একাধিক উপদল। সাবেক সিটি মেয়র আহসান হাবিব কামাল ও বরিশাল (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়দুল হক চাঁনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে পৃথক দুটি বলয়। তাদের অবস্থানও ক্রমশই শক্তপোক্ত হচ্ছে। এক সময়ের দুর্দান্ত প্রতাপশালী নেতা সরোয়ারের স্বেচ্ছাচারিতা ও নেতাকর্মীদের অবমূল্যয়ন করায় এখন অনেকেই এই নেতার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করেছেন। ফলে সাংগঠনিকভাবে নাজুক বিএনপি সরকারবিরোধী কোন আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে নামতে পারেনি। জাতীয় পার্টি সাংগঠনিক কর্মসূচি ঘরোয়াভাবে পালন করে অস্থিত্ব ধরে রাখছে। তৃতীয় শক্তি হিসেবে পরিচিত এই দলের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভাজন। জেলা শীর্ষ নেতা অধ্যাপক মহশিন উল ইসলাম হাবুল ও মহাগরের নেতা মর্তুজা আবেদিন এখন দুই মেরুর নেতা। উভয়ের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক হওয়ায় তাদেরও পৃথকভাবে কর্মসূচি পালনে মাঠে দেখা যায়। জামায়াত আছে নামে। কিন্তু গত ১০ বছরেও দেখা মেলেনি রাজপথে। এই অবস্থায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অংশ নানা কর্মসূচিতে রাজপথ দখল করে রাখছে।

দল ঘনিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়- কেন্দ্রীয় নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ পুত্র হওয়ায় সাদিক বাড়তি সুবিধা নিয়ে দলের মধ্যে নিজস্ব মত প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সৃষ্টি করেছে বিভাজন। প্রথমে মহানগরের নেতা নির্বাচিত পরবর্তীতে বিনা বাধায় সিটি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তরুণ এই নেতার দলের মধ্যে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। ফলে নানাভাবে বঞ্চিত অবহেলিত নতুন মেরুকরণ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় সদর আসনের সাংসদ কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) জাহিদ ফারুক শামীমের দিকে ঝুকছে নেতাকর্মীরা।

পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে জাহিদ ফারুক শামীম মন্ত্রিসভায় ঠাই পাওয়ার প্রবীন এই নেতা নিজেকে মেলে ধরতেও সক্ষম হয়েছেন। সংঘাত নয়, নিরবে পথ চল এমন নীতিতে বিশ্বাসী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী অল্প দিনের ব্যবধানে দলের একটি স্বতন্ত্র বলায় তৈরিতেও সক্ষম হন। পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ও অবহেলিত নেতাকর্মীদের বৃহৎ অংশ এখন জাহিদ ফারুক শামীমের রাজনৈতিক চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ সারির নেতাকর্মীরা এখন সাদিকবিরোধী অবস্থানে চলে গেছেন। ফলে জাহিদ ফারুক শামীম শক্তপোক্ত অবস্থান নিয়ে যে কোন সময় মাঠে শোডাউন দিতে পারেন।

তার অনুসারীদের মধ্যকার বেশ ককেজন জানান, সদর আসনের এই সাংসদ আ’লীগের আসন্ন দলের কাউন্সিলের ঘুরে দাড়াতে চান। মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে নিজেকে অধিষ্টিত করাসহ যুব ও ছাত্রলীগের কমিটিতে অনুসারীদের অবস্থান নিশ্চিতের অপেক্ষায় রয়েছেন। শোনা যাচ্ছে- ইতিমধ্যে সাংগঠনিক দুরদর্শিতা এবং সফল প্রতিমন্ত্রী হিসেবে জাহিদ ফারুক শামীম হাইকমান্ডের কাছে নিজের অবস্থান পরিস্কার করায় তার প্রত্যাশাও পূরণ হতে চলেছে। এসব কারণে জাহিদ ফারুকের বলয় ইতিমধ্যে দলের মধ্যে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নানা কারণে ইমেজ সংকটে পড়েছেন। নগর উন্নয়নের বদলে দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি ও এক নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতি করায় নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। সাদিক অব্দুল্লাহ পূর্বের ন্যায় কেন্দ্রের সাড়া পাচ্ছেন না। স্থানীয়ভাবে মাঠপর্যায়ে নেতামকর্মীদের বৃহত অংশ ক্রমশই তার সঙ্গ ছাড়তে শুরু করেছেন।

দলীয় কার্যালয়ের বদলে কালিবাড়ি সড়কের নিজের বাড়িতে সাংগঠনিক কর্মসূচি পালন করার বিষয়টি ত্যাগী নেতাকর্মীরা মানতে পারছে না। তাছাড়া গুটি কয়েক অনুসারীকে প্রাধন্য দেওয়াসহ আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ায় সুযোগ করে দেওয়ায় মেয়র সাদিকের বিরুদ্ধে ক্ষোভের অন্ত নেই।

নিজের কারণে কোনঠাসা হওয়ার পথে মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ এখন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমকে এখন প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে ভাবছেন। তবে জাহিদ ফারুক শামীম কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবতে নারাজ। দলীয় কর্মসূচি পালনে এই নেতাকে এক মঞ্চে দেখা গেলেও অধিকাংশ সময় উভয় নেতা থাকছেন দ্ইু মেরুতে। এই কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের নিরব বিদ্রোহের বিষয়টি।

বিরোধীদল বিএনপির ঘরেও স্বস্তি নেই। এতদিন পুলিশী নির্যাতন ও হয়রানির অভিযোগ তুলে আসা বিএনপির ঘরে এখন সরোয়ারবিরোধী আওয়াজই বেশি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বরিশাল সদর আসন থেকে ৫ বার নির্বাচিত সাংসদ মজিবর রহমান সরোয়ার কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে পদে থাকলেও পূর্বের ন্যায় সেই জনপ্রিয়তা নেই। দলের মধ্যে এক নায়কতত্ব আপাদকালীন নেতাকর্মীদের পাশে না থাকা এবং সুদিনে অবমূল্যয়ন করায় প্রভাবশালী এই নেতাকে এখন মাসুল গুনতে হচ্ছে।

দলের স্থানীয় নেতৃত্বর এখন অভিযোগ হচ্ছে- বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টিতে নারাজ সরোয়ারের কর্মকান্ডে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এখন বিদ্রোহী অবস্থান নিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে দলের দুসময়ে মাঠে থাকা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়দুল হক চাঁন লাইমলাইটে চলে এসেছেন। সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালও কম নন। দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিলকিছ জাহান শিরিনকে নিয়ে তিনিও দলের মধ্যে একটি সমান্তরাল মেরুকরণ সৃষ্টি করেছেন।

দলীয় কর্মসূচিতে সকল নেতাদের এককাতারে দেখা গেলে নীতিগত বিষয়ে রয়েছে ভিন্নমত। এনিয়ে সাম্প্রতিকালে দ্ব›দ্ব ও সংঘাতের নানা উদাহরণও দেখা গেছে। এখন অনেকেই চাইছেন- দলের মহানগরের নেতৃত্বে থেকে সরোয়ারের প্রস্থান। কিন্তু সাবেক এই সাংসদ কেন্দ্রীয় পদে থাকার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে পদ ধরে রাখতেও অনড়। এনিয়ে দলের মধ্যে কমবেশি বিরোধ মাঝে মধ্যে রাজপথ পর্যন্তও গড়ায়।

এ প্রসঙ্গে এবায়দুল হক বলেন- দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। স্থানীয় নেতৃত্ব নিয়ে বিভাজনের বিষয়টি স্বীকারও করেন। তবে তিনি সরোয়ারের প্রসঙ্গে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে নারাজ। তার ভাষায়- বর্তমানে দলীয় পদ নয়, খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি বেশি প্রাধন্য দিচ্ছেন। কিন্তু আকার ইঙ্গিত করে বোঝাতে চেয়েছেন বিকল্প নেতা সৃষ্টিতে সরোয়ারের আপত্তি থাকায় নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে রেখেছেন। সেই সাথে স্থানীয় নির্বাচনে সাংসদ ও সিটি মেয়র হিসেবে এক নেতা সরোয়ারই বারবার মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি ভাল চোখে দেখছেন না। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তার নিজস্ব মতামতও ব্যক্ত করেন। ফলে চানের সাথে যে সরোয়ারের দূরত্ব রয়েছে তাও স্পষ্ট।

মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিমত সরোয়ারের কারণেই বিএনপির দুর্গ বরিশালের রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনের দাড়াতেই পারছে না। যার দরুণ গত সাংসদ ও সিটি নির্বাচনে প্রার্থী সরোয়ার অনুসারীবিহীন একলা পথ চলেছেন। জাতীয় পার্টির অবস্থা আরও করুণ। মাঝে মধ্যে এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের রাজপথে দেখা গেলেও সাংগঠনিক কাঠামো একেবারেই নাজুক। দলের চেয়ারম্যান হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর এ চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেখানে সাংগঠনিক ভীত দুর্বল সেখানে জেলা ও মহানগরের দুই নেতা নিজেদের প্রভাব বিস্তারে বিরোধী জড়িয়ে পড়েছেন।

একজন আরেকজনকে সহ্য করতে না পারায় মর্তুজা আবেদিন বসেন দলীয় কার্যালয়ে হাবুল থাকেন নিজস্ব কার্যালয়ে। ফলে রাজপথের কর্মসূচিতে জোরালো কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। দুই নেত পৃথকভাবে নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে কর্মসূচি পালন করে সংগঠনের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখছেন। সাংসদ নির্বাচনে প্রার্থী না হলেও সিটিতে মেয়র নির্বাচনে ইকবাল হোসেন তাপসকে প্রার্থী করা হলে সেখানেও দলীয় বিভাজনে মহানগরের নেতৃবৃন্দ নিস্ক্রিয় থাকেন।

বরিশাল জেলা নেতৃবৃন্দ অধ্যাপক মহশিন উল হাবুলের নেতৃত্বে তাপসের নির্বাচনী কার্যক্রমে মাঠে নামলে অন্য গ্রুপ ক্ষমতাসীন দলীয় প্রার্থীকে সমর্থনে জানায়। একপর্যায়ে তাপস নিজেকে নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে গুটিয়ে নেন। সেক্ষেত্রে তাপসকে কেন্দ্র থেকে শাস্তিস্বরুপ বহিস্কারও করেন। এই নিয়ে বরিশাল জাপার মধ্যে বিরোধ আরও স্পষ্ট দেখা যায়। সেই থেকে মহানগর ও জেলার দুই নেতা পৃথক অবস্থান নিয়ে আছেন। এরশাদের মৃত্যুর পরে বরিশাল জাপায় গতি প্রকৃতি বুঝে ওঠা যাচ্ছে না।

শোনা যায়- কে হচ্ছেন দলীয় চেয়ারম্যান তা দিকে তাকিয়ে আছে উভয়গ্রুপ। দলের ভেতরকার সুত্রগুলো জানায় বর্তমানে ওশান এরশাদের সমর্থনে জেলার নেতৃবৃন্দ এবং জিএম কাদেরের পক্ষে মহানগরের নেতৃত্ব অবস্থান নিয়ে আছেন।

সব সময়ে কৌশলে পথচলা জামায়াতের অবস্থান এখন বরিশালে নেই বললেই চলে। মাঝে মধ্যে পুলিশী গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃবৃন্দের আটকের মধ্যদিয়ে জামায়াতের নেতৃত্ব আঁচ করা যায়। জামায়াতের শক্ত একটি ভোট ব্যাংক থাকলেও তা নাড়া দেওয়ার মত কোন নেতা গত ১০ বছরে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারেনি। ফলে জামায়াতকে এখন বরিশাল রাজনীতিতে কাগুজে বাগ বলা হয়। দলটির বরিশাল মহানগর আমির মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল এই আখ্যা মানতে নারাজ। তার ভাষায়- দলের ক্রান্তিকাল চলছে। সময় আসলে জামায়াতকে আবার স্বরুপে দেখা যাবে। ফলে বরিশালে নিরুত্তাপ রাজনীতিতে শুধু রাজপথে আওয়ামী লীগের একাংশকে প্লেকার্ড হাতে দেখা যায়।’

7 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন