২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বাকেরগঞ্জে সরকারি স্কুলভবন নির্মাণকাজে বাধা, ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:০১ অপরাহ্ণ, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাকেরগঞ্জে সরকারি স্কুলভবন নির্মাণকাজে বাধা, ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: বরিশালের বাকেরগঞ্জের রঘুনাথপুর পল্লীতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে বাধা দেওয়াসহ বড় অংকের একটি অর্থ চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। ঠিকাদার ১৩৫ নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিম রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণকাজ প্রাথমিকভাবে শুরু করলেও স্থানীয় মৃত আব্দুল মন্নানের ছেলে মোহতাসিম বিল্লাহ ওরফে নান্নু আকন ও তার লোকজনের বাধায় সেটি বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি এই উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ ব্যক্তি-বিশেষের বাধায় বন্ধ হয়ে গেলেও উপজেলা প্রশাসন কিংবা পুলিশ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিরব ভূমিকা নিয়ে সুশীলমহলে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। বিপরিতে স্কুল ভূমি নিজেদের দাবি করে মোহতাসিম বিল্লাহ ওরফে নান্নু আকন বরিশাল অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্টেট (এডিএম) আদালতে একটি নালিশী অভিযোগ ঠুকে দিলে ঠিকাদার লোকশানের আশঙ্কায় নতুন ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবং নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে মোতাসিম বিল্লাহ ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের সম্পত্তির প্রকৃত মালিক মৃত সোনামদ্দিন গাজীর নাতি কাওসার গাজীর কাছে ৫ লাখ টাকা অর্থ দাবি করেছেন।

কাওসার গাজী অভিযোগ করেন, তার দাদা মৃত সোনামদ্দিন গাজী একই এলাকার বাসিন্দা মোহতাসিম বিল্লাহ’র পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে ১৯৪০ সালে রঘুনাথপুর মৌজার ১৪৯ খতিয়ানের ২৯৪৪ নং দাগের ৩০ শতক এবং ৬৯৪ খতিয়ানের ২৯৮২ নং দাগের ২০ শতক ভূসম্পত্তি ক্রয় পরবর্তী সেখানে ‘১৩৫ নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিম রঘুনাথপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীতে স্বাধীনতাত্তোর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা দেশের প্রাইমেরী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারিকরণ ঘোষণা দিলে এই স্কুলটিও তার আওতায় আসে। এর পর থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে এই স্কুলটি অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছে। এবং এই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সুশিক্ষা গ্রহণ করে একাধিক ব্যক্তি-বিশেষ বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন, আবার কেউ কেউ রাজনীতিকরণের সুবিধার্থে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে- দীর্ঘ এত বছর স্কুলটি পরিচালনার ক্ষেত্রে কেউ কোনো বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি না করলেও সরকার যখন প্রতিষ্ঠানটি আধুনিকায়নে উদ্যোগ নিল, ঠিক তখনই স্থানীয় বাসিন্দা মোতাসিম বিল্লাহ বাধ সাধলেন এবং ভবননির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিতে ভূমির মালিকানা দাবি করে আদালতে নালিশী অভিযোগ ঠুকে দিলেন। তবে নালিশী করার ক্ষেত্রেও এই ব্যক্তি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন বলে প্রতীয়মাণ হয়, তিনি অভিযোগে কোথায়ও সরকারি স্কুলভবন নির্মাণের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। জানা গেছে, আদালত সেই নালিশীটি আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বাকেরগঞ্জ থানা পুলিশকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নির্দেশ দেওয়াসহ স্থানীয় ভূমি অফিসকে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ভবন নির্মাণকাজের শুরুতে দফায় দফায় বাধা এবং পরবর্তীতে স্কুলের ৫০ শতাংশ ভূমির ৩০ শতাংশ ওয়ারিশসূত্রে মালিকানা দাবি করে মোতাসিম বিল্লাহ আদালতে নালিশ করলে ঠিকাদার অর্থ আটকে যাওয়ার আশঙ্কায় ঠিকাদার কাজ বন্ধ করে দেন। এনিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক, সুশীলমহল এবং শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সঞ্চার করলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না, যা রহস্যেরে সৃষ্টি করেছে। বরং ঠিকাদার ভবনের কাজ বন্ধ রাখার সুযোগকে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এখন প্রকৃত ভূমি মালিক অর্থাৎ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সোনামদ্দিনের নাতি কাওসারের কাছে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করা হচ্ছে।

কাওসার অভিযোগ করেন, তার দাদা সোনামদ্দিন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শিক্ষার মানোন্নয়ে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার লক্ষে কিছু ভূমি মোহতাসিম বিল্লাহ’র পূর্বপুরুষদের কাছে থেকে ক্রয় করেন এবং তার পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত ভূমি মিলয়ে ৫০ শতাংশ সম্পত্তিতে ‘১৩৫ নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিম রঘুনাথপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ দান করেন। স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধু সারাদেশের প্রাইমেরী বিদ্যালয়সমূহকে সরকারিকরণ করলে এই প্রতিষ্ঠানটিও তালিকাভুক্ত হয়।

কাওসারের দাবি, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাইমেরী শিক্ষাগ্রহণ করে অসংখ্য ছেলে-মেয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে, আবার কেউ হয়েছেন রাজনৈতিক। অথচ যখন স্কুলটি আধুনিকায়নে সরকার উদ্যোগ নিল, ঠিক তখনই একটি পক্ষ স্কুলের ভূমির বড় অংশ ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত দাবি করে নির্মাণকাজে বাধা তৈরি করল। এমনকি আদালতে নালিশী অভিযোগ করার পর আবার ৫ লাখ টাকা দাবি করছে। মোহতাসিম বিল্লাহ এবং তার লোকজন এই অর্থ দাবি করেছেন বলে অভিযোগ করেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সোনামদ্দিনের নাতি কাওসার।

যদিও স্কুলের ভূমির মালিকানা দাবি করে মোহতাসিম বিল্লাহ আদালতে যে নালিশী করেছেন, সেখানে সোনামদ্দিনের নাতি কাওসারকে বিবাদী করা হয়নি। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শাহীন জোমাদ্দার, প্রধানশিক্ষক শাহিদা বেগম, জমিদাতা সোনামদ্দিন গাজীর ভাইয়ের ছেলে খালেক গাজী, নাতি আনোয়ার গাজী, রুহুল আমিনসহ মোট ৬ জনকে বিবাদী করেছেন।

কাওসারের অভিযোগ, এডিএম আদালতে মোহতাসিম বিল্লাহ নালিশী করার পর ঠিকাদার স্কুলভবন নির্মাণকাজ বন্ধ রাখলে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এবং তিনি এর প্রতিবাদ করায় এখন বিভিন্ন মাধ্যমে তার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করছেন।

এক্ষেত্রে ঠিকাদার জাহাঙ্গীর হোসেনের ভাষ্য হচ্ছে, সম্প্রতি তিনি স্কুলভবনের কাজ শুরুর পর ওয়ারিশসূত্রে ভূমির মালিকানা দাবি করে দফায় দফায় বাধা সৃষ্টি করে একটি পক্ষ। এবং তারা এডিএম কোর্টে একটি নালিশীও করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে একটি জটিল পরিবেশ তৈরি হওয়ায় ভবননির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে, যে বিষয়টি তিনি থানা ইঞ্জিনিয়ারকেও অবহিত করেছেন বলে দাবি করেন। তবে তার কাছে কেউ অর্থ দাবি করেনি বলেও জানান তিনি।

এই সরকারি স্কুলভবন নির্মাণকাজে বাধা দেওয়ার বিষয়টি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) বাকেরগঞ্জ থানা ইঞ্জিনিয়ার আবুল খায়ের স্বীকার করলেও কার কাছে ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত ভূমি মালিক দাবিদার মোহতাসিম বিল্লাহ অর্থ চেয়েছেন তা জানা নেই বলে জানান।

মি. খায়ের বলেন, স্থানীয় শিক্ষা অফিসারকে ভূমি বুঝিয়ে দিতে বলা হয়েছে। এবং ভূমির কাগজপত্র অর্থাৎ স্কুলের নামের দলিলপত্র পেলেই পুনরায় ভবন নির্মাণকাজ শুরু হবে। তবে সরকারি স্কুল ভবন নির্মাণকাজে বাধা সৃষ্টি করে কেউ যদি চাঁদাবাজি করে তাহলে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।

অনুরুপ মন্তব্য করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, যারা স্কুলভবন নির্মাণকাজে বাধা দিয়েছে এবং ভূমির মালিকানা দাবি করে আদালতে নালিশী করেছে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এবং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার নাতির কাছে যে অর্থ দাবি করেছে, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি স্কুলের ভূমির দলিলপত্র তল্লাশি চলছে।

স্থানীয় পার্দীশিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির ভূমি এতদিন পরে কেন ওয়ারিশসূত্রে মালিকানা দাবি করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হচ্ছে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত কিছুতেই বরদাস্ত করা হবে না জানিয়ে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসন ও থানা পুলিশের সাথে আলোচনা হচ্ছে, কিভাবে দ্রুত নির্মাণকাজ শুরু করা যায়।

সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণকাজে বাধা দেওয়া এবং অর্থ দাবি করার বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি বা মৌখিকভাবেও অবহিত করে বলে দাবি করে বাকেরগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি/তদন্ত) সত্য রঞ্জন খাসকেল বলেন, যদি এমনটি হয়ে থাকে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কারণ স্কুলের ভূমি, তদুপরি বঙ্গবন্ধুর আমলে সরকারিকরণ হয়েছে, এমন প্রতিষ্ঠানের কাজ বন্ধ করে দেওয়া এবং পরিশেষে চাঁদাবাজি, তা কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

তবে স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, মোহতাসিম বিল্লাহ স্কুলের ভূমি ওয়ারিশসূত্রে দাবি করলেও তিনিও জানান যে ওই ভূমি তার পূর্বপুরুষেরা সোনামদ্দিনের কাছে বিক্রি করেছেন। এবং সোনামদ্দিন সেই জমি দান করে সেখানে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

সূত্রগুলো জানায়, ওয়ারিশসূত্রে ভূমির মালিকানা দাবি করার নেপথ্য কারণ হচ্ছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরখানেক আগে শূন্যপদে একজন দপ্তরি নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে মোহতাসিম বিল্লাহ তার পরিবারের একজনকে এই পদে নিয়োগ পেতে সুপারিশ রেখেছিলেন। কিন্তু যোগ্যতার ভিত্তিতে অপর একজন নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি এবং তার পরিবারের লোকজন সংক্ষুব্ধ হন। মূলত এই ক্ষোভের কারণেই তিনি এখন নতুন স্কুলভবন নির্মাণ কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন এবং সর্বশেষ স্কুল প্রতিষ্ঠাতার নাতি কাওসারের কাছে অর্থ দাবি করেছেন।

তবে মোহতাসিম বিল্লাহ স্কুলের যে ভূমি ওয়ারিশসূত্রে দাবি করেছেন, তার মালিকানা এখনও তার পূর্বপুরুষেরা বলে জানালেও এর স্বপক্ষে কোনো অকাট্ট প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এমনকি তার কোনো দলিলও তার কাছে নেই। আদালতে তিনি যে কাগজপত্র দেখিয়েছেন, তাতে শুধু তার পূর্বপুরুষদের নামে রেকর্ড দেখা গেছে।

এক্ষেত্রে স্কুল প্রতিষ্ঠাতার নাতি কাওসারের ভাষ্য হচ্ছে, ভূমিটি ক্রয়ের পর দলিল করলেও তার দাদা রেকর্ড পরিবর্তন করেননি। প্রায় ৫০ বছর পরে এসে এখন মোহতাসিম বিল্লাহসহ তার স্বজনেরা ভূমির মালিকানা দাবি করেছেন, যেটা অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া  তার কাছে যে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে, সেই ঘটনায় তিনি মোহতাসিম বিল্লাহসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলার প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে জানান।’

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন