২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

দুই ইউএনও, এক ডিসির গল্প

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:১৭ অপরাহ্ণ, ২৮ জুলাই ২০১৭

ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে এগারোটা। ঘুম আসছিলো না চোখে। শুয়ে শুয়ে টিভির পর্দায় চোখ রেখে ডুবে আছি গভীর ভাবনার জগতে। ভাবনার জগৎ জুড়ে আর কেউ না, দুজন সরকারি আমলা! একজন ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) এবং একজন ডিসি (জেলা প্রশাসক)। এ দুজনের মাঝখানে হাঠাৎই অনুপ্রবেশ আরেক ইউএনওর!

ঘড়ির কাঁটা তখন রাত বারোটা অতিক্রম করেছে। হঠাৎ টিভিতে দেখতে পেলাম অগৈলঝড়ার ইউএনও গাজী তারেক সালমানকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! টিভির পর্দায় আর সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন সব ছবি দেখে এবং এর পেছনের সাজানো ঘটনার কথা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।

চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় প্রথম ও দ্বিতীয় হওয়া দুই শিশুদের আঁকা স্বাধীনতা যুদ্ধ ও জাতির জনকের ছবি দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর মতো একটি সুন্দর ও মহৎ কাজের অপব্যাখ্যা দিয়ে ওই ইউএনও’র বিরুদ্ধে মামলা ঠুকা হলো!

বিষয়টি নিয়ে ভাবতে ভাবতেই রাত গভীর। ভাবনার জগতে তখনও এক ইউএনও এবং একজন সাবেক ডিসি বিরাজ করছিলেন। যাদের দায়িত্ব পালন আমি কাছ থেকে দেখেছি। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এ দেশে হাতেগোণা যে ক’জন সরকারি চাকরিজীবী মানুষ প্রাণন্তর চেষ্টা করে চলেছেন, অমানিশার অন্ধকার ঠেলে দেশকে আলোর পথে নিয়ে যেতে, সে দলেরই এ দুজন। চলুন তাদের দুজনকে দেখে আসি একটি গল্পের মধ্য দিয়ে।

‘ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি’। কুমিল্লা সেনানিবাস সংলগ্ন কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মাহসড়কের পাশে দৃষ্টিনন্দন একটি স্থান। কেউ একে বলেন ইংরেজ কবরস্থান, কেউবা বলেন খ্রিস্টান কবরস্থান। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সেনা সদস্যদের এখানে সমাহিত করা হয়েছিলো। তারা বিভিন্ন দেশের নাগরিক ছিলেন এবং ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও ধর্মের অনুসারী ছিলেন। সুতরাং শুধু ইংরেজ বা খ্রিস্টান বলা সঠিক হবে না।

সে যাই হোক, যখনই এ দৃষ্টিনন্দন স্থানটির পাশ দিয়ে যাতায়াত করি তখনই নিজের ভেতরটায় কেমন যেন নাড়া দিয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়া প্রভাত কুমার মুখপাধ্যায়ের ‘ফুলের মূল্য’ গল্পটির কথা। গল্পের লেখক একবার পাশ্চাত্যের দেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তখন এমন একজন লোকের সাথে পরিচয় হয়, যার ভাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। সে জানায়, তার ভাই যুদ্ধে নিহত হলে তাকে ভারতবর্ষে সমাহিত করা হয়েছে (কোনো এক ওয়ার সিমেট্রি’)। তিনি লেখকের হাতে কিছু টাকা তুলে দিলেন, ফুল কিনে তার ভাইয়ের সমাধিতে দেয়ার জন্যে।
তখনকার সময় এদেশে টাকা দিয়ে ফুল কিনতে হতো না, কথাটি জেনেও লেখক টাকাটা নিয়েছিলেন, লোকটির আত্মতৃপ্তির কথা ভেবে। যে গল্পটি পড়ে জীবনে প্রথম চোখে জল এসেছিলো আমার।

গল্প পড়ে চোখে জল এসেছিলো আবেগে। গল্পের সেই যুদ্ধসমাধী স্থলটির দিকে তাকালে জল এখনও আসে। চোখে নয়, হৃদয়ের গহীনে। কারণ এ জল আবেগের নয়, কষ্টের। যুদ্ধসমাধী স্থলটির নান্দনিক সৌন্দর্য আমাকে যেমনটি মুগ্ধ করে, ঠিক তেমনি ব্যথিতও করে।

ভিনদেশিরা সাত সমুদ্দুর তোরোনদী পাড়ি দিয়ে এদেশে এসে একটি সমাধিস্থল এতো সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখতে পারে! অথচ একবার ভাবুন এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এদেশের চিত্রটা কেমন?! ভাবতেই কষ্টের অশ্রু ফল্গুধারার মতো বয়ে যায় ভেতরে ভেতরে।

আমাদের দেশের যে দিকেই তাকাই সেদিকেই চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় শুধু কষ্টের চিত্র। দিন দিন আমরা ঘাতকের জাতিতে পরিণত হচ্ছি! অস্ত্রেই নয়, খাদ্যেও। মুনাফা অর্জনের জন্য মানুষ হয়ে মানুষের খাদ্যে বিষ মিশিয়ে তা বাজারে বিক্রিকরা! তা কতো নিষ্ঠুর, অমানবিক হলে সম্ভব?! অথচ আমরা প্রতিনিয়ত তা’ই করছি! খাদ্যে কার্বাইড ও ফরমালিনের মতো প্রাণঘাতি কেমিকেল মেশানো হচ্ছে এদেশে!
এ যেন রূপকথার গল্পের মতোই এক দেশ!

সরকারি চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বার, শিক্ষকের কোচিং বাণিজ্য, সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতির অভিযোগ! শুধু তাই নয়, ওজনে কম দেয়া, মূল্য বেশি রাখা, লোক ঠকানোসহ আরো কতো প্রকার অনিয়ম! চারপাশ ছেয়ে আছে অনিয়ম, রাহাজানীতে! অনিয়মটাই যেখানে নিয়মে পরিণত হয়ে আছে এদেশে!

আমরা এক ভূতুরে অমানিশার অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছি! ভাবতেই গায়ে শিহরণ জাগে! এই অন্ধকার রাত কাটিয়ে সকালের সোনার রবির অন্বেষণ করতে হবে। কিন্তু কে করবে?

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এই দেশে জনপ্রতিনিধি ও নেতারা ভোটের মৌসুমে জনগণের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলেন, মনে হয় যেন ক্ষমতায় গেলে তিনি ও তার দল দেশটাকে পাল্টে দেবেন। আমি নিজেও বিশ্বাস করতে শিখেছি, নেতাদের সেসব কথাগুলো যদি কাজের কথা হতো, তাহলে সত্যিই দেশটাকে পাল্টে দেয়া সম্ভব, মাত্র এক সপ্তায়! কিন্তু বাস্তবতা হলো উল্টো।

চারপাশে যে দিকেই তাকাই, শুধুই হতাশার চিত্র! সময়ের সাথে সাথে নেতাদের সেসব কথা কথার কথায় পরিণত হয়! আর আমরা অপেক্ষায় চেয়ে থাকি আরেকটি নির্বাচনের। কিন্তু নির্বাচন আসতে আসতেই সবকিছু দিব্বি ভুলে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিই আবার নতুন করে। তাইতো কবি লিখেছেন, “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে”।

এতো কিছুর পরও নিরাশবাদী নই। আমি স্বপ্ন দেখা মনুষ। স্বপ্ন দেখতেই ভালোবাসি। ঘুমিয়ে নয়, জেগে। যেমনটি বলেছিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম। আর এ কারণেই যেখানে এতোই হতাশার গল্প, সেখানে আশার আলো দেখতে পাই কিছু কিছু দেশপ্রেমী মানুষের মাঝে। তবে, তারা সংখ্যায় নিতান্তই নগণ্য। আর এই অল্পসংখ্যক স্বদেশপ্রেমী মানুষগুলোর বেশিরভাগই সরকারি কর্মচারী।

পেশায় সংবাদকর্মী হওয়ার সুবাদে সরকারি-বেসরকারি অনেক শ্রেণি পেশার লোকের সঙ্গে উঠাবসার সুযোগ হয়েছে। অসংখ্য কালো মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই আমি অনেক ভালো মানুষও দেখেছি। কাছ থেকে দেখা এমন দু’জন নিষ্ঠাবান মানুষের কথা না বললেই নয়। তাদের একজন কুমিল্লার সাবেক ডিসি মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল, অপরজন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ইউএনও সালেহীন তানভীর গাজী।

আমি একজন সাধারণ মানুষ হয়ে কারো ব্যক্তিগত জীবন বা অন্তরাত্মার খবর জানার কথা নয়। তবে, যেটুকু জানি তা হলো, তারা কবিতার মতোই শুধু কথায় নয়, কাজে বড় হবার মানসিকতা সম্পন্ন। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছেন নিরলস ভাবে।

মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল। কুমিল্লায় ডিসি হিসেবে যোগদানের তৃতীয় দিন থেকে পরিচয় তার সাথে। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ‘সচীণদেব বর্মণের পৈত্রিক বাড়িতে হাস-মুরগীর খামার’! এমন একটি প্রতিবেদনে তার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম।
আমার মনে আছে তিনি আগে কাজে নেমেছিলেন, পরে আমার ক্যামেরায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সচীণদেব বর্মণের পৈত্রিক বাড়িতে কালচারাল কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

তারও বছর খানেক পরের গল্প। জনাব কল্লোল এর কাছে গণমানুষের দাবি নিয়ে যখনই গিয়েছি দিন নেই রাত নেই তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। একবার জনাব কল্লোল সরকারি কাজে তিনদিনের জন্যে কুমিল্লার বাইরে। এমন সময় কুমিল্লার ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী পূবালী ব্যাংকভবনটি গভীর রাতে ভেঙে ফেলছিলো একটি মহল। তখন কল্লোল মহোদয়কে ফোনে পাচ্ছিলাম না। ফেসবুকে তাকে নক করলাম। তিনি দূরে থেকেও গভীর রাতেই পুলিশ ও প্রতিনিধি পাঠিয়ে ভবনটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করলেন।

একই ভাবে তিনি ফেসবুক ম্যাসেজকে গুরুত্ব দিয়ে অভিযান পরিচালনা করে মাইলের পর মাইল অবৈধ গ্যাস লাইন ও শত শত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে শত শত কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যদিও নিন্দুকদের কাছে কোনো ভালোই ভালো না।

আমি বলবো, জনাব হাসানুজ্জামান কল্লোল আজ কুমিল্লায় নেই কিন্তু সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সময়োপযোগী কাজের সাথে জড়িয়ে আছে তার নামটি।

গর্বিত সেই ব্যক্তিরা

অন্যদিকে প্রজাতন্ত্রের আরেক নবীন কর্মকর্তা সালেহীন তানভীর গাজী। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ইউএনও। মাস তিনেক হবে কুতুবদিয়া থেকে এখানে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এরই মধ্যে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছেন তিনি।

আপাদমস্তক সংস্কৃতিমনা এই মানুষটির দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডগুলোতে নির্মোহের ছাপ স্পষ্ট। চারপাশে যখন সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার খবর শুনি; যখন দেখি অভিযোগ অনুযোগ করেও সরাকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে নাগরিকরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। ঠিক তখন সালেহীন তানভীর গাজীর নাগরিকদের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা বোধ করি ইতোমধ্যেই আমার মতো লাখো মানুষকে মুগ্ধ করেছে।

রমজানে বাজার মনিটরিং, ঈদুল ফিতরের আগে পোশাকের বাজার থেকে শুরু করে খাদ্য সামগ্রীর বাজার পর্যন্ত ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ, মান ও মূল্য নির্ধারণ নিশ্চিত করা। প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পণ্যের মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। নৌপথে যাত্রীদের নিরাপত্তায় বিশেষ করে স্পিডবোটে লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক করা, ভাড়ার নির্ধারণের ব্যবস্থা করাসহ কোথায় তিনি হাত লাগাননি?

এর সবকিছুই করছেন তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বলে কয়ে, আগাম সতর্ক বার্তা দিয়ে এবং জনগণের উন্মুক্ত মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই। সেবার খাতগুলো নিজে থেকেই চিহ্নিত করে সেগুলোতে মান নিশ্চিত করতে ভূমিকা নিচ্ছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বিনোদন ও ক্রীড়া থেকে শুরু করে উপজেলার এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে এই অল্প সময়ের মধ্যে তার হাত প্রসারিত হয়নি।

চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমাজতত্ব বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দিন। যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন এক মানুষ। তারই ছেলে ইউএনও সালেহীন তানভীর গাজী। কথায় বলে না বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া।

ইউএনও সালেহীন তানভীর গাজীর এমন নিরলস প্রচেষ্টার পরও যখন দেখি গোটা সমাজটাই চেয়ে থাকে একটি মানুষের দিকে; তখন মনে হয় যতো দায় যেন ইউএনও’র! লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত এ দেশে একজন গাজীর ভূমিকায়, আর সবাই দর্শক! তাহলে এদেশ থেকে অমানিশার অন্ধকার কি করে দূর হবে?

নিজের কাজ নিজে না করে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে উল্টো তাকেই ফাঁদে ফেলার দিন আর নেই। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হলো- অগৈলঝড়ার ইউএনও গাজী তারেক সালমান। তাকে হাতকড়া পরিয়ে অন্যরা কিন্তু শান্তিতে নেই। তাই এখনই সময় একে অপরের হাতে হাত রেখে দেশকে এগিয়ে নেয়ার শপথ করার।

তাইতো কবি লিখেছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে”। সুতরাং প্রতিটি তরুণকে এ কবিতাটি শপথ বাক্য হিসেবে বুকে ধারণ করার সময় এসেছে এখনই।

লেখক: জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল, পরিচালক, ঐতিহ্য কুমিল্লা, সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশন। ইমেইল: imrul60@gmail.com

5 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন