২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

কর্নেল-খোকনের ‘নতুন বরিশাল’ হোক, রাজনৈতিক সন্ত্রাসমুক্ত!, এটাই শহরবাসীর প্রত্যাশা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৭:৫৩ অপরাহ্ণ, ১০ জুলাই ২০২৩

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল>> রাজনীতির মাঠে উভয়েই ক্লিন ইমেজের এবং সৎ-স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন হিসেবে সমাধিক পরিচিত। বিপরিতে উভয়ে বরিশালের স্থানীয় রাজনীতিতে স্বল্পসময়ে পেয়েছেন বেশ জনপ্রিয়তা, প্রসংশিত হয়েছেন, হচ্ছেন আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডে। ক্ষমতাসীন আ’লীগ ঘরনার রাজনৈতিক এবং জনপ্রতিনিধি হলেও উন্নয়ন কর্মকান্ডের বদৌলতে তাদের এই দলের বাইরেও রয়েছে সুনাম। এতক্ষণ যাদের কথা বলছিলাম, তাদের একজন বরিশাল সদর আসনের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) জাহিদ ফারুক শামীম, অপরজন বরিশাল সিটির নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের ওরফে খোকন সেরনিয়বাত। নয়া এই মেয়র এখন পর্যন্ত বিসিসির দায়িত্বভার গ্রহণ না করলেও তার ওপর বরিশালবাসী যে আস্থা রেখেছে, তার প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। ১২ জুন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের পঞ্চম মেয়াদের নির্বাচনে তাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছে জনগণ।

খোকন সেরনিয়াবাতকে ভোটে নির্বাচিত করতে নেপথ্য কারিগর যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন বরিশাল সদর আসনের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনসহ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৫ আসনে জনপ্রতিনিধি তিনি। খোকন সেরনিয়াবাতকে নিয়ে ভোটের মাঠে নামার আগে এবং জয়লাভের পর উভয় জনপ্রতিনিধির সম্পর্কের কোনো ঘাটতি নেই। বরং তারা অভিন্ন মেরুতেই অবস্থান করছেন। তারা দুজনেই নির্বাচন পূর্বাপর স্থানীয় বাসিন্দাদের বারংবার অঙ্গীকার করে আসছেন, বরিশাল হবে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, মাদকসহ ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাসমুক্ত একটি শহর’। তাদের এই প্রতিশ্রুতির প্রতি বরিশাল শহরবাসীর যে আস্থা আছে, তার প্রমাণ ১২ জুনে ভোটে পেয়েছেন। এবং বিপরিতে কর্নেল-খোকন তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় অভীষ্ট লক্ষে এগিয়ে চলছেন, কী ভাবে সন্ত্রাসমুক্ত বরিশাল নগরী গড়ে তোলা যায়।

যদিও ইতিমধ্যে উভয় জনপ্রতিনিধিই ঘোষণা দিয়েছেন এবং নয়া মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচনী ইশতেহারেও প্রতিশ্রুতি ছিল তিনি ‘নতুন বরিশাল’ গড়বেন। জনপ্রতিনিধির ওই আশ্বাস শহরবাসীর মনে আস্থা জুগিয়েছে, বেড়েছে নাগরিক প্রত্যাশাও।

কারণ এমপি জাহিদ ফারুক শামীম তাঁর আওতাধীন এলাকাসমূহ অর্থাৎ সদর উপজেলার ভাঙনরোধসহ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে যথেষ্ট ভুমিকা রাখলেও প্রভাবশালী একটি মহলের বাধায় বরিশাল নগর উন্নয়নে ইচ্ছা এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো কাজ করতে পারেননি। এনিয়ে প্রতিমন্ত্রীকে আলোচনার প্রাক্কালে ক্ষেত্র বিশেষ আফসোস করতেও শোনা যায়। বছর দুয়েক পূর্বে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শহর অভ্যন্তরের ফুসফুস খ্যাত ৬টি খাল সংরক্ষণ করাসহ পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নিলে সিটি কর্পোরেশনের বাধায় তা আটকে যায়।

অথচ শহরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা অন্তত শহর অভ্যন্তরের খালগুলো সংরক্ষণ করে যেনো নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করা হয়। এনিয়ে সাবেক সফল সিটি মেয়র শওকত হোসেনের বেশ উদ্যোগও ছিল, কিন্তু তার মৃত্যুর পর বরিশাল সিটির তৃতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামাল মেয়র নির্বাচিত হলে, তিনিও খাল উদ্ধারে তেমন কোনো ভুমিকা রাখেননি। এরপর চতুর্থ পরিষদ নির্বাচনে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র নির্বাচিত হলে তিনিও খালগুলো উদ্ধারে ভূমিকা রাখেননি, বা রাখতে পারেননি। যদিও সিটি কর্পোরেশনের তরফে মাসছয়েক আগেও বলা হচ্ছিল, শহর অভ্যন্তরের খালগুলো উদ্ধারে প্রকল্প চলমান আছে, কিন্তু এই বলাবলির মধ্যে মেয়র সাদিকে মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। আর মাত্র তিন মাস পরেই তাঁর আপন চাচা খায়ের আব্দুল্লাহ সিটির মসনদে বসবেন।

নাগরিক সমাজের ভাষ্য হচ্ছে, যেহেতু এমপি জাহিদ ফারুক শামীম বরিশাল শহর উন্নয়ন প্রশ্নে আন্তরিক আছেন এবং নতুন মেয়র খোকন সেরনিয়বাতেরও অঙ্গীকার আছে, সেক্ষেত্রে আগামীতে উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় জলাবদ্ধতা দূরিকরণে সমাধান আসছে এটা বলার অপেক্ষা নেই। সৎ-স্বচ্ছ এবং ক্লিন ইমেজের এই দুই জনপ্রতিনিধি আগামীতে যে ‘নতুন বরিশাল’ গড়ার অঙ্গীকার করছেন, তাও বাস্তবায়নের কিছু আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু এখন নগরবাসীর মধ্যে যে প্রশ্ন বেশি ভার সেটি হচ্ছে, জনপ্রতিনিধিদ্বয় টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, মাদক ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসমুক্ত ‘নতুন বরিশাল’ গড়তে কতটা সফল হবেন? এবং বরিশালে বর্তমানে রাজনৈতিক পরিচয়ে দখল-পাল্টা দখলের যে উৎসব চলছে! তা নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করছেন, না কী করবেন।

বলা বাহুল্য যে, বিগত সময়ে বরিশাল শহর উন্নয়ন অপেক্ষা সন্ত্রাসীদের উৎপাত বেশি লক্ষ্যণীয় ছিল। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে একটি অংশ নিজের আখের গুছিয়েছে, দেখিয়েছে ত্রাস, ক্যাডাভিত্তিক সন্ত্রাসের ভয়ে বলতে গেলো তটস্থ ছিল বরিশালবাসী। ভয়ে মুখ না খুললেন, আশায় ছিল পরিবর্তনের। আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ বরিশাল সিটিতে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে আসলে নগরবাসী সুবর্ন সুযোগটি লুফে নেয়, ভোট দিয়ে তাকে নগরপিতার আসনে বসিয়েছেন। কিন্তু শহরবাসীর অতীত রাজনৈতিক সন্ত্রাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, যা কিছুটা হলেও ভুলতে চান প্রতিমন্ত্রী-মেয়রের দৌত নগর উন্নয়নে।

অভিজ্ঞমহলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হচ্ছে, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে ‘ক্যাডারভিত্তিক’ রাজনীতি করে কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের চেয়ার বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি, যার প্রমাণ ইতিমধ্যে বরিশালের মানুষ পেয়েছেন। কিন্তু এরপরেও সুযোগ-সন্ধানী একটি অংশ থাকে তারা সার্বক্ষণিক নিজেস্ব স্বার্থ সংরক্ষণের ধান্দায় ব্যস্ত, এরাই মূলত সমাজ এবং রাজনীতির বিষফোঁড়া। তাদের অবস্থান বিগত সময়েও বিদ্যমান ছিল, এখনও আছে। যার দরুণ অনেকে ক্লিন ইমেজের জনপ্রতিনিধি জাহিদ ফারুক এবং খোকন সেরনিয়াবাতের দিতে আঙ্গুল তুলতে সাহস দেখাবেন। আবার দলীয় ঘরানার বিরোধীরা পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখছেন এবং হাসছেন, কেউ কেউ দিচ্ছেন উস্কানিও।

রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অভিমত হচ্ছে, স্বচ্ছ-সৎ মানসিকতার জনপ্রতিনিধি জাহিদ ফারুক এবং খোকনকে বিতর্কিত করতে দলীয় ঘরানার একটি অংশ মরিয়া হয়ে আছে। তারা সর্বদা চাইছেন কোনো কোনো ইস্যু তৈরি করে এই দুজনকে কী ভাবে ঝামেলায় মধ্যে ফেলা যায়। এসব বিষয় নিয়ে বরিশালের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে চর্চা শোনা যাচ্ছে। ফলে উভয় রাজনৈতিকের লক্ষ্য-উদ্দেশ হবে নিজেদের সতর্কতার সাথে পথা চলা এবং কর্মী-সমর্থকদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং কোনো প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখা। কারণ তারা প্রতিমন্ত্রী ও নয়া মেয়রের ইমেজ যে কোনো সময় ম্লান করে দিতে পারে বিতর্কিত কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে। এক্ষেত্রে তাদের ওপর বিশেষ খেয়াল দিতে হবে, যারা দল বদল করে বিএনপি-জামায়াত থেকে এসেছে।

মহলটি বলছেন, সিটি নির্বাচনের মাসখানেক আগে থেকে বর্তমান সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ অনেকটা অন্তর্ধানে চলে যাওয়ার পরে বরিশালে ক্ষমতাসী দলের নেতাকর্মীদের সৃষ্ট বেশ কয়েকটি ঘটনা বিশেষ করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান-ঘাট-বাজার দখল, চাঁদাবাজি এবং মারামারিতে রক্তপাত নেতিবাচক রাজনীতি জানান দিচ্ছে, যা এমপি বা নতুন মেয়র কেউ সমর্থন করেন না। কিন্তু তারপরেও একের পর এক এই ধরনের ঘটনা ঘটেই চলছে, অনুঘটকরা জনপ্রতিনিধিদের নাম সামনে রেখে এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করায় ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিতেও সাহস পাচ্ছেন না। আবার জনপ্রতিনিধিরাই মিডিয়ার সামনে আনুষ্ঠানিক বলছেন, দখলবাজ বা সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

তাহলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, বরিশালে গত দুই মাসে যে দখল পাল্টা দখলের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তা কী ভিত্তিহীন বা অবান্তর? আবার যারা এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড যারা করছেন তারা কী আইনে উর্ধ্বে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করছে না (!)

এক্ষেত্রে সুশীলমহলে অভিমত হচ্ছে, কর্নেল এবং খোকন সেরনিয়াবাতকেই এই রাজনৈতিক সন্ত্রাস রুখে দিতে হবে এবং তাদের দুজনের সদিচ্ছাও আছে, তারা পারবেনও। তবে এটা সময়ের ব্যাপার, কারণ বরিশাল সিটির মেয়র এখনও মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। বরিশাল সিটির মসনদে বসতে খোকন সেরনিয়াবাতের অপেক্ষা করতে হচ্ছে তিন মাসের অধিক সময়। হয়তো তিনি দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই রাজনৈতিক সন্ত্রাস দমনে যে অঙ্গীকার করেছেন, তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবেন।

সিটির নাগরিকেরা বলছেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে জাহিদ ফারুক শামীম একই সাথে সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে প্রতিশ্রুতির কিছুটা হলেও বরিশালবাসীকে দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি (বরিশাল ৫ আসন) সদর আসনের আওতাধীন বরিশাল উপজেলার রাস্তা-ঘাট উন্নয়নের পাশাপাশি নদী ভাঙন রক্ষায় যে অগ্রণী ভুমিকা রেখেছেন, তা সর্বমহলে আলোচিত এবং আলোড়িত। ফলে তার কাছে জনগণের আশা-আকাঙ্খা আরও বেড়েছে। পাশাপাশি বিপুল ভোটে জয়ী খোকন সেরনিয়াবাতের কাছেও তার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাইছেন জনতা।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিমন্ত্রী-মেয়রের এই সদিচ্ছায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস বড় বাধা হতে পারে কী না, যেমনটি হয়েছে সাবেক সফল মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরনের মৃত্যুর পরে। সর্বশেষ কাশিপুরে গত দুদিন পূর্বে দুই জনপ্রতিনিধির অনুগত ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে যে সংঘাত-রক্তপাত হলো তা রাজনীতির ইতিবাচক ধারা বলে মনে হচ্ছে না, মন্তব্য পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন মাধ্যম জানা গেছে, কাশিপুরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় প্রতিমন্ত্রী-মেয়র উভয়েই হার্ডলাইনে আছেন। এ ধরনের ঘটনা আগামীতে কোনো প্রকার প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী-মেয়র। এমনকি কাশিপুরের ওই ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করতে তারা দুজনেই পুলিশকে কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।

ফলে ধারনা বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে প্রতিমন্ত্রী-মেয়রের ‘নতুন বরিশাল’ গড়ার ক্ষেত্রে যারা বড় বাধা হয়ে উঠবে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার! আর যারা দখল পাল্টা দখল এবং চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে ধাবিত হয়ে রাজনৈতিক ব্যানারে সন্ত্রাস করার কথা ভাবছেন, তাদের অবস্থা আরও করুন হতে পারে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ‘মানবতার মা’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাও অনুরুপ। সেক্ষেত্রে কর্নেল-খোকনের আগামীর ‘নতুন বরিশাল’ যে শান্তিময় হবে তা আর অস্বীকার করার সুযোগ থাকছে না।

হাসিবুল ইসলাম, কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিক এবং সভাপতি, ‘নিউজ এডিটরস্ কাউন্সিল, বরিশাল’।

 

112 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন