২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

শিক্ষার অবক্ষয় বনাম শিক্ষকের নৈতিকতার বিপর্যয়

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ, ৩০ অক্টোবর ২০২৩

শিক্ষার অবক্ষয় বনাম শিক্ষকের নৈতিকতার বিপর্যয়

প্রফেসর ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনবাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ নানান সমস্যায় জর্জরিত। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা। পৃথিবীব্যাপি একটি স্বতঃসিদ্ধ উক্তি আছে- ‘প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচিত হয় সেটির শিক্ষক দ্বারা, শিক্ষকের কর্মদক্ষতা, সক্ষমতা, মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারা শিক্ষাকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে।’ অর্থাৎ শিক্ষকরাই হলো প্রতিষ্ঠানের মেইন ফ্যাক্টর বা প্রধান স্তম্ভ তথা মূল চালিকাশক্তি। আমরা যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করি বা করেছি তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকেই আমার আজকের এই লেখার অবতারণা।

শুধু শিক্ষাই নয়, সারা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমর্যাদা নিরূপণ হয় শিক্ষা ও গবেষণার মানের উপর ভিত্তি করে- যা মূলত নির্ভর করে শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রয়াসের উপরেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই শিক্ষকরাই নানাভাবে নিগৃহীত ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের শোষণ ও অধিকার হরণের মূলে রয়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারগণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরে তারা নিজের গদি সুরক্ষা ও কিছু ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য নিজের পক্ষে একটি তোষামোদি গ্রুপ সৃষ্টি করেন। নিজের অনুগত বাহিনী তৈরি করতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বিদ্যমান ঐক্যের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করেন। নানান লোভ-লালসা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের পক্ষে টেনে আস্থাভাজন শিক্ষকদের নিয়ে দলবাজি শুরু করেন।

ফলে অল্প কিছুদিনেই শিক্ষকদের মধ্যে সুস্পষ্ট একটি বিভাজন তৈরি হয়। এক্ষেত্রে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তি ব্রিটিশদের সেই ‘Divide and Rule’ পলিসি অবলম্বন করে নিজের মনের মতো প্রশাসন পরিচালনার অপচেষ্টা করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা সফল হয়ে থাকেন নিজের অনুগত সেই তোষামোদি গ্রুপের সহযোগিতায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল, ক্ষমতার দাপট ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই এসব করা হয়। এমন হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসেই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব এবং শিক্ষার পরিবেশ অবনমিত করা হয়। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম পালনে একদল সবসময় সচেষ্ট থাকেন। তাদের কাছে শিক্ষা এবং গবেষণার মূল্য অতি নগণ্য। এদিকে অপর গ্রুপকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকতে হয়। ফলে তারাও শিক্ষা আর গবেষণায় মনোনিবেশ করার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হন।

দেশের শিক্ষাঙ্গনে এই অবক্ষয়ের চিত্র এখন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। কর্ণধারদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য আজ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নিয়োগের প্রক্রিয়াটাও স্বচ্ছ নয়। কর্ণধার নিয়োগে প্রায়ই মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও ম্যানেজারিয়াল স্কিলনেস, এসব কিছুই বিবেচনা করা হয় না বললেই চলে। নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে তোষামোদি রাজনৈতিক বিবেচনা ও সংযোগ স্থাপনের দক্ষতা তথা লবিংয়ের উপরই বেশি নির্ভর করে। ফলে অনেক সময়ই প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা করা হয় না এসব নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। ফলে এর সরাসরি কুপ্রভাব পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থায়।

অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, যার কথা কেউ কখনো চিন্তা করেনি কিংবা যার ওই চেয়ারে বসার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা নেই এমন কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়। লবিং আর তদবিরের জোরে বাগিয়ে নেওয়া হয় চেয়ার। ফলে তাঁর যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার অভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব নিয়মকানুন আর নীতি-নৈতিকতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের কর্ণধার নিয়োগে সঠিক কোনো নীতিমালা না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বজনপ্রীতি, তোষামোদি কিংবা অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে কার্যসম্পাদন হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটা অনেকটা ওপেন সিক্রেট ঘটনা।

এভাবে অনৈতিক পন্থায় যারা নিয়োগ লাভ করেন সঙ্গত কারণেই তাদের কোনো দায়বদ্ধতা কিংবা জবাবদিহিতা থাকে না। ফলে দায়িত্ব পেয়েই তিনি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। সর্বক্ষেত্রে স্বৈরাচারী আচরণ শুরু করেন। অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এসব কারণেই এখন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মিডিয়ার শিরোনাম হয়। বেশকিছু বিশ্ববিদ্যায়ের কর্নধারদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ, ক্ষমতার চরম অপব্যবহার এবং চারিত্রিক ও নৈতিক স্খলনসহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগের খবর হরহামেশাই শোনা যায়। এজন্য অনেককে চাকরিচ্যুত হয়ে এমনকি শ্রীঘরে পর্যন্ত যেতে হয়।

অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নানাবিধ বিভাজন সৃষ্টি করেন। এতে তিনি নিজে লাভবান হলেও শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। অনেকে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে থেকে অনেকে মিথ্যার আশ্রয়, প্রতারণা, কথা দিয়ে কথা না রাখা, মোনাফেকি আর বিশ্বাসঘাতকতা করার মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। ফলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার যোগ্যতা হারান তিনি। এসব অযোগ্য ব্যক্তিরা নানান কূটকৌশলে কাঙ্ক্ষিত নিয়োগ বাগিয়ে নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও গবেষণাকে মারাত্মক হুমকির মধ্যে নিপতিত করেন।

আমার এক বন্ধু আক্ষেপ করে বলেন- ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়োগ দেওয়া হয় না, নিয়োগ নেয়া হয়।ছলেবলে, কৌশলে কিংবা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে। ফলে এই নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি, দেশ ও জাতির প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। তাদের মাঝে থাকে না সততা, দেশপ্রেম, শুদ্ধাচার কিংবা নীতি-নৈতিকতার বালাই। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি- যিনি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হন মূলত তাঁর ইচ্ছার উপরেই সবকিছু নির্ভর করে। সর্বত্র কর্তার ইচ্ছায় কর্ম এবং কীর্তন হয়। এর ফলে মারাত্মক প্রভাব পড়ে শিক্ষা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে। এসব কারণেই আজ শিক্ষার বিপর্যয় ঘটেছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় দেখা দিয়েছে চরম অবক্ষয়। আমাদের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব বর্তমানে সুস্পষ্টভাবে সর্বত্র দৃশ্যমান।

বিশ্বের বহুল প্রচলিত ও স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান পরিমাপক পদ্ধতি টাইমস হায়ার এডুকেশন (THE) কর্তৃক Ranking-2024’এ বিশ্বের ১০৮ টি দেশের ১,৯০৪ টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে বাংলাদেশের ২১ টি বিশ্ববিদ্যালয় ‌র‌্যাঙ্কিংয়ে ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে স্থান পেয়েছে। এরমধ্যে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরের অবস্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরে পর্যায়ক্রমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ-সাউথ, বাকৃবি, বুয়েট, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।

তবে এবারই প্রথম দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সামনে চলে এসেছে।
The Times Higher Education World University Ranking-2024 adopts methodology which includes 18 carefully calibrated performance indicators that measure an institution’s performance across five areas: teaching, research environment, research quality, industry, and International outlook.

যে পাঁচটি ইন্ডিকেটরস তথা সূচক দিয়ে শিক্ষার মানদণ্ড বিশ্লেষণ করা হয় সেগুলোর সব কয়টির সাথেই শিক্ষকগণ ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। সেই শিক্ষকদের নিয়ে যদি নানান বিরোধ ও গ্রুপিং সৃষ্টি করা হয় তাহলে সবকিছুই মুখ থুবড়ে পড়বে সন্দেহাতীতভাবে। তাছাড়া কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ভিশন নিয়ে কাজ না করে নিজের ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য নিয়ে মহান শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন সেক্ষেত্রে যা হবার তা-ই হবে এবং বর্তমানে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সামগ্রিক বিষয়ে দক্ষতা, মেধা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপরেই মূলত অনেক কিছু নির্ভর করে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষক আছেন যাদেরকে উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ দিলে তারা শিক্ষা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন।

সকল বিষয়ে মেধা সৃষ্টি করার পরিবেশ সংরক্ষণ করার প্রাথমিক দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। যে কথা দিয়ে আমার লেখাটা শুরু করেছিলাম তা ছিল সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কম্পোনেন্ট হলেন শিক্ষক। আর সেই শিক্ষকদের সঠিকভাবে ব্যবহার ও পরিচালনার দায়িত্ব হলো প্রতিষ্ঠান প্রধানের। তাই সততা, নিষ্ঠা ও নীতি-নৈতিকতার সাথেসাথে সব ধরনের লোভ-লালসার উর্ধ্বে উঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। এটা না পারলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক মেরুদণ্ডহীন জাতিতে পরিণত হবে।

দেশে শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি মেধা সৃষ্টি করা না যায়, সততা ও দেশপ্রেম তৈরি করা না যায় তাহলে আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের কথা বলছি তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। শুধু মেধা থাকাই যথেষ্ট নয়। যে মেধার মধ্যে সততা এবং শুদ্ধাচার না থাকে সেই মেধা মূল্যহীন। পক্ষান্তরে এমন মেধা দেশ ও জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। এছাড়া সামনে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) যুগ; যা সম্পূর্ণভাবে নতুন ধারণার উপর ভর করে সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করবে। আমাদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের এই যুগে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগীকরণ, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ এবং শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতার বিপর্যয় রোধ করতে না পারলে অমানিশার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। #

লেখকঃ প্রফেসর ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন
প্রাক্তন উপাচার্য,
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম নেতা।

72 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন