২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

ইভটিজারকে রক্ষায় বরিশালে লঙ্কাকান্ড, স্তম্ভিব নগরীতে ধিক্কার

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:৫০ অপরাহ্ণ, ২১ জানুয়ারি ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: অপ্রত্যাশিত অথবা নিলজ্জতা ভেঙে বরিশাল ক্ষমতাসীন দলের একাংশ তাদের অনুসারী একজনকে ইভটিজার যুবককে রক্ষায় গোটা নগরী অচল করে দেয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতার দিক-নির্দেশনায় পিনিক সৃষ্টি করে ৩০টি ওয়ার্ড থেকে একযোগে মোটরসাইকেল মহড়া পাশাপাশি সড়ক ও নৌপথ বন্ধ করে দেয়। সেই সাথে কাউনিয়া থানামুখী বিপুল সংখ্যক লোকের স্রোত সৃষ্টি করায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় গোটা নগরীর দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে পুলিশকে চাপের মুখে রেখে ইভটিজার সেই সোহাগকে থানা থেকে ছাড়িয়েতো নেয়ই, উপরন্ত ওই যুবককে আটক ভুমিকা রাখায় বিসিসিকের একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকসহ একাধিক কর্মচারীর বিরুদ্ধে উল্টো মামলা দায়েরে বাধ্য করে। ঘটনার সূত্রপাত বুধবার সকালে হলেও সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত একজন ইভটিজারকে ছাড়িয়ে আনতে ক্ষমতাসীন মহলের এই তান্ডব ছিল এই যাবতকালের বরিশালের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।

দোকানপাট বন্ধ, গাড়ির চাকা অচল কিন্তু এর পেছনের কারণ কী তা কেউ বুঝে উঠতে পারেনি, জনমনে জিজ্ঞাসা ছিল কী ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে? একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, বিসিক শিল্পনগরীর ‘ফরচুন সু’ কোম্পানির সাথে প্রভাবশালী একজন আওয়ামী লীগ নেতার দীর্ঘদিন ধর দ্বন্দ্বে ক্ষমতার ষোলআনা দেখাতে এবং ওই প্রতিষ্ঠান মালিককে নাজেহাল করতেই ইভটিজার সোহাগের পক্ষ নেওয়ায় সামান্য ঘটনা দীর্ঘ রুপ দেওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, বুধবার সকালে বিসিক অভ্যন্তরে দুই নারী শ্রমিককে সোহাগ ওরফে মাছ সোহাগ উত্যক্ত করে। এসময় অপরাপর শ্রমিকেরা এই যুবককে অবরুদ্ধ করার একপর্যায়ে মারধর করতে উদ্যত হলে সেখানে আকস্মিক উপস্থিত ‘ফরচুন সু’ কোম্পানির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান তাদের নিবৃত করেন। পরে ওই যুবককে বিসিকে দায়িত্বরত পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পর কাউনিয়া থানা পুলিশ তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়। সকাল সাড়ে ১১টার এই ঘটনার পর কাউনিয়া থানা পুলিশ নারী উত্যক্তের অভিযোগে ওই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার বিপরিতে একটি লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেয়। সেই অনুযায়ী সোহাগকে একক আসামি করে একটি অভিযোগ দিয়ে আসার পর পুলিশ তা এজাহার হিসেবে গ্রহণে কালক্ষেপন শুরু করে। ততক্ষণে গুজব ছড়ানো হয়, এই মামলায় একজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাসহ সাবেক ছাত্রনেতা যে কী না শ্রমিক রাজনীতিতে প্রবেশে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

সন্ধ্যার ভেতর এই গুজব অনেকটা পিনিক আকারে রুপ নেয়। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, সোহাগ যেহেতু তাদের অনুগত এবং ফরচুন সু কোম্পানি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বি হওয়ায় শীর্ষ ওই আওয়ামী লীগ নেতা বিষয়টিকে মোক্ষম ইস্যু হিসেবে লুফে নিয়ে বরিশাল উত্তপ্ত করার দিক নির্দেশনা দেয়। এর পরেই ওয়ার্ড ভিত্তিকসহ বিভিন্নস্তরের নেতাদের যার যার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে থানামুখী যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া দেওয়া হয়। সেই সাথে বিভিন্নপ্রাপ্ত উঠতি বয়সের যুবকদের মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে প্রথশে শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, যাতে দোকানপাট আপনাআপনি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। দেখা গেছে- এক দঙ্গল যুবক বিভিন্ন সড়কপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বরিশাল শহরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ অচল করে দেয়। পাশাপাশি নৌ ও বাস টার্মিনালে ওই নেতার নির্দেশ পৌছামাত্র দূরপাল্লার লঞ্চ ও বাস চলাচল স্থগিত রাখা হয়।

শহর যখন অচল, তখন কাউনিয়া থানামুখী শুরু হয়, মিছিল সহকারে আ’লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগসহ শ্রমিকেরা অনেকটা জনস্রোতের মতো সেখানে গিয়ে ঠেকে থানা ঘেরাও করে। দেখা গেছে, মহানগর আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা দিক-নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু মূল ভুমিকায় ছিলেন কাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা ওই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সমাবেত দলীয় লোকদের অংশগ্রহণে অনেকটা জনসমাবেশ আকারে সেখানে নিজেই অগ্নিঝড়া বক্তব্য দেন। তার দাবি বা ভাষ্য ছিল, সোহাগ বাস শ্রমিক নেতা, যাকে অকারণে আটকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এই সোহাগ পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ী এবং ফরচুনের সাথে সমসাময়িককালে শীর্ষ আ’লীগ নেতার সাথে দ্বন্দ্বে সে ভুমিকা রেখে কয়েক দফা বিসিকে মহড়া দেয়। এমনকি হামলাও চালায়। এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কাউনিয়া থানায় একটি মামলাও রয়েছে। সেই সোহাগকে এবার ফরচুন কোম্পানির চেয়ারম্যান নিজেই না কী পিটিয়ে পুলিশে দিয়েছেন। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা এই তথ্যের সাথে একমত নয়। এমনকি বিসিকে কর্মরত পুলিশও একই কথা বলছে। একপর্যায়ে সাবেক ওই ছাত্রনেতা ফরচুন কোম্পানির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানকে গ্রেপ্তার এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খানকে অপসারণের দাবি তোলেন। তার এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করে তাদের অনুসারীদের থানা অভিমুখে আসার এক ধরনের আহবান জানানো হয় বলে অনেকের অভিমত পাওয়া গেছে।

অপর একটি সূত্র জানায়, এই ঘটনার আগে শীর্ষ ওই আওয়ামী লীগ নেতার পরিকল্পনায় মিজানুর রহমানসহ আরও ১০/১৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় একটি এজাহার দিয়ে আসে। থানার সামনে যখন হট্টোগোল, তখন শহরে আতঙ্ক ও অচল অবস্থায় মেট্রো পুলিশ প্রশাসন দিশেহারা হয়ে পড়ে। এসময় ওই এলাকায় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা যায় এবং পুলিশ প্রশাসনের উচ্চমহলের সাথে তাৎক্ষণিক খবরাখবর দিতে দেখা গেছে। একপর্যায়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আবার কেউ বলছে, পুলিশের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা থাকলেও সেদিকে হাটেনি। বরং উদ্বুদ্ধ অবস্থা সামাল দিতে অথবা ক্ষমতার কাছে পুলিশ প্রশাসন নতি স্বীকার করে সোহাগকে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এসময় মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে দাখিল করা এজাহারটিও মামলায় রুপ দেওয়া হয়। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসলে প্রায় দুই হাজারের অধিক আগন্তক ক্ষমতাসীনদের ব্যানারে আসা জনতা থানা এলাকা ত্যাগ করে।

কিন্তু ইভটিজারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উপরন্ত ফরচুনের বিরুদ্ধে কেন মামলা নেওয়া হলো এই বিষয়ে দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। রাত ১১টা পর্যন্ত ফরচুনের পক্ষে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের দায়ের করা এজাহারটি মামলা হিসেবে গ্রহণে অনুরোধ রেখে মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি/উত্তর) খাইরুল আলমসহ উর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তার সাথে রুদ্ধদার বৈঠক শেষে জানানো হয় সোহাগের ইভটিজিংয়ের বিষয়টি বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) তদন্তসাপেক্ষ মামলা নেওয়া হবে। এসময় ইভটিজিংয়ের শিকার ওই দুই নারী শ্রমিকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশের এই একপেশে ভুমিকায় ফরচুন কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, পুলিশের প্রতি তাদের আস্থা যেমন ক্ষীণ তেমন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ। গতকাল বুধবারের এই ঘটনায় বরিশালের সুশীল সমাজসহ খোদ আ’লীগের কোনো কোনো নেতা, এমনকি অনেক পুলিশ কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে নানা মন্তব্য করলেও কেহই নিজের উদ্ধৃতি দিয়ে অভিমত প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। শুধু বলছেন, এক রাজার রাজ্যে এখন যা চলছে, তা রীতিমত ভিন্ন কোনো ভুখন্ডে বসবাস সমতুল্য।

এদিকে খবর পাওয়া গেছে, নাশকতার আশঙ্কায় ভুগছে ফরচুন সু কোম্পানি। বিদেশে রপ্তানিকারক এই প্রতিষ্ঠানে ১০ হাজার কর্মচারীর রুটি-রুজি নিয়ে শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীনদের টানাটানি। এই অবস্থায় এ কোম্পানির ভবিষ্যত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কেউ কেউ। নানা সূত্র জানিয়েছে, মিজানুর রহমানকে বিসিক থেকে উৎখাতের প্রথম পদক্ষেপের অংশ বিশেষ তাকে গ্রেপ্তারে চাপ সৃষ্টির নতুন কৌশল নেওয়া হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে তিনি ন্যায়ের পথে রয়েছে, কোনো অপশক্তির কাছে আপসের প্রশ্নই ওঠেনা। এদিকে বরিশালে এখনও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সর্বত্রই আলোচনা চলছে, পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়?

23 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন