২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

নদীভাঙন থেকে ১৪ ফুট দূরে নির্মিত হচ্ছে ৪০ লাখ টাকার স্কুলভবন!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ, ১২ মার্চ ২০২৪

নদীভাঙন থেকে ১৪ ফুট দূরে নির্মিত হচ্ছে ৪০ লাখ টাকার স্কুলভবন!

আরিফ আহমেদ মুন্না:: ভাঙন কবলিত নদীর পাড় থেকে স্কুলের দূরত্ব ঠিক ১৪ ফুট। যেখানে জরুরি ভিত্তিতে ভেঙে সরিয়ে নেওয়া দরকার ভাঙন ঝুঁকিতে থাকা পুরাতন স্কুল ভবনটি সেখানে তড়িঘড়ি করে নির্মাণ করা হচ্ছে ৪০ লাখ টাকার আরেকটি নতুন ভবন। ‘সরকারি মাল, দরিয়াতে ঢাল’-এ প্রবাদ বাক্যটির যেন যথাযথ বাস্তবায়ন চলছে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ভাষ্য, নদী পাড়ের ডিক্রিভুক্ত ওই জমিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নয়। নদী থেকে নিরাপদ দূরত্বে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশেই রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিজস্ব রেকর্ডিয় ৩৬ শতক সম্পত্তি। তথাপিও নিজস্ব জমি রেখে নদী পাড়ের সেই অবৈধ জমিতেই ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে বহুমুখী লুটপাটের অভিসন্ধিতেই এমন তুঘলকি কান্ড করছে ম্যানেজিং কমিটি। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৮৫ সালে সন্ধ্যা নদীগর্ভে বিলীন হয়। এরপরে স্থানীয় একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের ভবনে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হয়। একটি বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থায়নে ভবনটি নির্মাণ করেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। সেই থেকে রমজানকাঠী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রটিই রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সম্প্রতি বিদ্যালয়ের সেই অস্থায়ী ভবনটিও ভাঙন ঝুঁকির মুখে পড়লে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিজস্ব জমিতে নতুন ভবন তৈরির উদ্যোগ গ্রহন করে কর্তৃপক্ষ। নতুন ভবন তৈরির জন্য ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণকাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় এলজিইডি।

তবে নির্মাণ কাজটি কুক্ষিগত করার জন্য বিদ্যালয়ের নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ম্যানেজিং কমিটি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তা বাতিল করে গঠন করা হয় নতুন ম্যানেজিং কমিটি। ১১ সদস্যের ওই নতুন কমিটির সদস্য করা হয় একই বাড়ির ৫ জনসহ তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের। কথিত জমিদাতা সদস্য স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকাশ্যে বিরোধিতাকারী হিসেবে পরিচিত পাশের গ্রামের মৃত আব্দুল লতিফ মীরের শ্যালকের পুত্র আব্দুল মান্নান খান হাতিয়ে নেন নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি। নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের চত্ত্বরে থাকা মেহগনি ও রেইন্ট্রিসহ ১০টি গাছ অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করে নির্বাচন ছাড়াই গঠিত পকেট ম্যানেজিং কমিটি। গাছের বাজার মূল্য ৩ লক্ষাধিক টাকা হলেও তারা এর নিলাম বিক্রিমূল্য নির্ধারণ করে মাত্র ২৬ হাজার টাকা।

স্থানীয় বাসিন্দা উপজেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য মোঃ ফারুক হোসেন বিশ্বাস অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা ফিতা দিয়ে মেপে দেখেছি নতুন স্কুল ভবনের দক্ষিণ পাশের বেইজ পিলার থেকে ভাঙনরত নদী পাড়ের দূরত্ব ঠিক ১৪ ফুট। আগামী বর্ষা মৌসুমের ভাঙ্গনেই এই জায়গার স্থাপনাসমূহ নদীগর্ভে বিলীন হবে। তবুও এলজিইডি কোন স্বার্থে নদী ভাঙ্গনের এতটা কাছে নতুন এই ভবন নির্মাণ করছে তা অনুসন্ধান করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। এখানে বহুমুখী লুটপাটের একটা সংঘবদ্ধ আয়োজন চলছে।

প্রথমত ভবন নির্মাণের নামে এখানের গাছ কেটে লুট করা, দ্বিতীয়ত লোকচক্ষুর অন্তরালে নদী পাড়ে যেনতেনভাবে ভবন তৈরি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা, তৃতীয়ত নদীগর্ভে বিলীনের পথে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের ভবনটি ভেঙে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা, পরবর্তীকালে নতুন স্কুলভবনটি নদী ভাঙনের মুখে পড়লে তখন ভাঙন প্রতিরোধের নামে আরেকদফায় বরাদ্দ এনে লুটপাট এবং সর্বশেষ ভাঙনের অজুহাতে আবার নতুন ভবনটি নিলামকরণের মাধ্যমে লুটপাটের ষোলকলা পূর্ণ করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।’ স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদের স্বার্থ তারা কখনো দেখেনি আর দেখবেও না বলে ক্ষোভের সঙ্গে জানান ছাত্রলীগ নেতা ফারুক হোসেন বিশ্বাস।

 

অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিদাতার ছেলে স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল বারেক মোল্লা ও রমজানকাঠী গ্রামবাংলা বিদ্যাপীঠ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে বিশিষ্ট সমাজসেবক সাইফুর রহমান সোহেল। সাইফুর রহমান সোহেল আরও বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমোদন, জেলা জজ আদালতের রায়, উপজেলা শিক্ষা কমিটির রেজ্যুলেশনের সিদ্ধান্ত, সবকিছুই এখানে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। শুধু ম্যানেজিং কমিটির একটা কথিত রেজ্যুলেশনের ক্ষমতাবলে লুটেরা চক্রের স্বার্থ হাসিলের জন্য সম্পূর্ণ খামখেয়ালির মাধ্যমে নদীর পাড়ের অবৈধ জমিতে স্কুলভবন নির্মাণ করছে এলজিইডি।’

রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তৃপ্তি রানী চন্দ্র বলেন, ‘আমি মুখ খুললে এখানে চাকরি করতে পারবো না। তাই ম্যানেজিং কমিটি যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয় সেভাবেই আমাকে চলতে হয়। বর্তমানে যেখানে স্কুল আছে এবং যেখানে নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে সেখানে বাচ্চাদের স্কুলের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। জায়গাটি নদীভাঙন পাড়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া এই জমিটিও স্কুলের বৈধ জমি নয়। গ্রামবাংলা হাইস্কুলের পাশে মহাপরিচালকের নামে দলিলকৃত স্কুলের নিজস্ব রেকর্ডিয় জমিতে কেন নতুন স্কুলভবন করা হচ্ছে না তা আমার বোধগম্য নয়।’

অভিযুক্ত রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শরীফ জিয়াউদ্দিন মনির বলেন, ‘স্কুল থেকে নদীভাঙন খুব কাছে এটা সত্যি তবে এখানে নতুন স্কুল ভবন করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু টাকাপয়সা খরচ করতে হয়েছে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের বর্তমান ভবনটির পেছন ঘেঁষে নতুন ভবনটি করা হচ্ছে। যে জায়গা দেখিয়ে বরাদ্দ আনা হয়েছে সেখানেই ভবন করা হচ্ছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।’ প্রতিষ্ঠানের নামে আসা সরকারি বরাদ্দ ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির জন্য নদীতে অপচয় করার এখতিয়ার কারও আছে কিনা, -এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি।

এদিকে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির একই সুরে সুর মিলিয়ে নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘স্কুল ম্যানেজিং কমিটি রেজ্যুলেশন করে সাইট সিলেকশন করেছে। আমরা শুধু ঠিকাদার দিয়ে নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছি। তাছাড়া ম্যানেজিং কমিটি যথেষ্ঠ টাকাপয়সা খরচ করে সেখানে চর ডিজাইনের নতুন ভবনের জন্য ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ এনেছে। সুতরাং ভবনটি ওখানেই করতে হবে। তাছাড়া ওটা যদি নদীতে ভেঙে যায় তখন এমনিতেই স্কুল মূল জমিতে সরিয়ে নেওয়া হবে।’ বিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্রয়কৃত এবং রেকর্ডিয় জমি থাকতেও নদীভাঙন কবলিত অবৈধ জমিতে কেন সরকারি অর্থ অপচয় করবেন, -এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি উপজেলা প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম রাকিব।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ মুনিরুল হক বলেন, ‘রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মালিক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কোথায় স্কুল হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন মহাপরিচালক। সেখানে ম্যানেজিং কমিটির সাইট সিলেকশন করার কোনো এখতিয়ার নেই। দলিল অনুযায়ী গ্রামবাংলা বিদ্যাপীঠ হাইস্কুলের পাশে রমজানকাঠী মৌজার ৪০০ নম্বর খতিয়ানের ১৩৮ ও ১৪০ নম্বর দাগের ৩৬ শতাংশ জমি রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রকৃত জমি, যা নিয়মানুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি মহোদয়ের নামে দলিল করা এবং ভূমি অফিস থেকে মিউটেশন করা। নদীপাড়ের ওই জমি স্কুলের নয়। এটা এলজিইডিকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। তারপরেও সেখানে কীভাবে নতুন স্কুলভবন নির্মাণ হচ্ছে সেটা আমরা জানি না।’

বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাকিলা রহমান বলেন, ‘রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ বিষয়ক জটিলতার কথা আমি জেনেছি। স্কুল নির্মাণের জমি নির্ধারণ করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সেখানে নিয়মানুযায়ী ঠিকাদারের মাধ্যমে নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করবে এলজিইডি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্ধারিত জমির পরিবর্তে কেউ যদি অন্যত্র স্কুলভবন নির্মাণের চেষ্টা করে, সেই দায়ভার তাকেই নিতে হবে।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, ‘কোনো সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষ নদীভাঙন কবলিত জায়গায় শিশুদের স্কুলভবন নির্মাণে সম্মতি দিতে পারে না। ভবন নির্মাণের অজুহাতে সেখানে থাকা কয়েক লাখ টাকার গাছ নামমাত্র ২৬ হাজার টাকা মূল্য নির্ধারণ করে আত্মসাৎ চেষ্টার অভিযোগ পেয়ে গাছ কাটা বন্ধ করে দিয়েছি।’

124 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন