২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

নির্বাচনি ব্যয়সীমা মানছেন না প্রার্থীরা

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১২:২২ অপরাহ্ণ, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল : নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ধার্যকৃত নির্বাচনি ব্যয়সীমা মানছেন না অধিকাংশ প্রার্থী। ভোটার যা-ই হোক না কেন, আসনপ্রতি এক জন প্রার্থীর সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করার বিধান থাকলেও অনেকেই কয়েক গুণ ব্যয় করছেন। অবশ্য ভোটের মাঠে আসলে কত টাকা খরচ হচ্ছে, তা নিরূপণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় প্রার্থীরা দেদার খরচ করার সুযোগ নেন। ব্যয়সীমার প্রতি প্রার্থীরা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চলেছেন। যদিও ইসি বলছে, বাস্তবে ব্যয়সীমা মনিটরিং করা কঠিন কাজ। তবে প্রার্থীর জন্য ধার্যকৃত খরচ এবং উৎসের বাইরে ব্যয় করলে সর্বোচ্চ সাত বছর থেকে সর্বনিম্ন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান আছে। যদিও এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, বাস্তবে প্রার্থীদের ব্যয়সীমা মনিটরিং করা একটু কঠিন। তবে কোনো প্রার্থী ধার্যকৃত ব্যয়সীমার অতিরিক্ত খরচ করলে তা দেখভালের জন্য মাঠে রয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

ইসির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধার্যকৃত ব্যয়সীমা বাস্তবে খুবই কম। বেশির ভাগ প্রার্থীই ব্যয়সীমার অধিক খরচ করে থাকেন। কিন্তু তার হিসাব ইসির কাছে গোপন করা হয়। ইসিকে অন্ধকারে রেখে দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, কালো টাকার মালিকেরাই মূলত ভোটের মাঠে টাকা ছড়াছড়ি করেন। টাকার সংকটে অসৎ সম্পদের অধিকারীদের কাছে যোগ্য ও সত্ প্রার্থীদের পরাজিত হওয়ার অসংখ্য নজির আছে। ভোটের মাঠে কালোটাকার ছড়াছড়ি ঠেকানোর সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান না থাকার সুযোগ গ্রহণ করেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ১৫ নভেম্বর ভোটারপ্রতি ১০ টাকা খরচের হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছিল ইসি। ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ৪৪ (খ) অনুযায়ী দলীয় অনুদানসহ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনি খরচ ২৫ লাখ টাকার বেশি হবে না। যেহেতু নির্বাচনি ব্যয় ভোটারপ্রতি হারে নির্ধারিত হওয়ার বিধান রয়েছে, সেহেতু ইসি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় ভোটারপ্রতি নির্বাচনি ব্যয় ১০ টাকা নির্ধারণ করল। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনে ভোটার রয়েছেন প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ। আরপিও অনুযায়ী, এই ব্যয় একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাব থেকে বহন করতে হয়। সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে প্রতিদিনের ব্যয় ভাউচারসহ সংরক্ষণ করে নির্বাচনের ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। কোনো প্রার্থী নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে জমা না দিলে তার বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান রয়েছে।

দলের নির্বাচনি ব্যয়: আরপিও অনুযায়ী দল সর্বোচ্চ ৫০ জন প্রার্থী দিলে ব্যয় করতে পারবে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা। ৫১-১০০ প্রার্থী দিলে সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা। ১০১-২০০ প্রার্থীর জন্য দলের নির্বাচনি ব্যয় ৩ কোটি টাকা। দুই শতাধিক প্রার্থী দিলে সংশ্লিষ্ট দল সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে পারবে। আরপিওর ৪৪ সিসিসি-বিধি অনুযায়ী, ভোটের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের পর ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। তা অমান্য করলে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারে ইসি। এমনকি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের বিধানও আছে।

ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার যুগ্ম-সচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান জানান, একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ভোটারপ্রতি ১০ টাকা নির্বাচনি ব্যয় ছিল প্রার্থীদের। এবারও ভোটারপ্রতি একই ব্যয় ঠিক করা হয়েছে।

অতিরিক্ত খরচ করলে দণ্ড: আরপিওর ৭৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কর্তৃক দাখিলকৃত বিবরণী বা সম্পূরক বিবরণীতে উল্লেখিত উত্স ভিন্ন অন্য কোনো উৎস থেকে কোনো নির্বাচনি ব্যয় বহন করলে বা ধার্যকৃত ২৫ লাখের অধিক খরচ করলে তিনি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হবেন। তিনি অনধিক সাত বছর থেকে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

নিয়ম মানেন না প্রার্থীদের কেউই: এবারের সংসদ নির্বাচনে ২৭টি রাজনৈতিক দলের ১ হাজার ৮৯৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ৩৮৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। এখন পর্যন্ত ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে। এছাড়া জাতীয় পার্টি (জাপা)র জন্য যে ২৬টি আসন ছেড়েছে আওয়ামী লীগ, সেখানেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। ফলে ভোটে জয় পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন প্রার্থীরা। বিজয় হওয়ার মানসিকতার কারণে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে প্রার্থীদের। দুর্নীতিবাজ এবং অসৎ প্রার্থীদের কাছে থাকা কালো টাকা নির্বাচনের মাঠে ছেড়ে সাদা করছেন সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরা। এসব অসৎ প্রার্থীর অধিকাংশই টাকা ব্যাংকেও রাখেন না।

২৫ লাখ টাকা অপর্যাপ্ত: নির্বাচনি ব্যয়সীমার জন্য ধার্যকৃত ২৫ লাখকে অপর্যাপ্ত বলছেন ভোটার, প্রার্থী ও সমর্থকদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, নির্বাচনে বিজয়ী হতে কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকার পোস্টার বাবদ খরচ হয়ে যায়। এর বাইরে নির্বাচনি ক্যাম্প খরচ, প্রচারণা খরচ, ভোটের দিন আসনপ্রতি দেড় শ কেন্দ্রে এজেন্টের পেছনে খরচ তো আছেই। এছাড়া বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় প্রার্থীদের অদৃশ্য খাতে বড় একটি অংশ খরচ হিসেবে চলে যায়। ফলে ইসির ধার্যকৃত ব্যয়সীমা যে কোনো প্রার্থীর কাছে যৎসামান্যই।

নির্বাচনি ব্যয়সীমার বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অনেক হেভিওয়েট ও দুর্নীতিবাজ প্রার্থী কখনোই ইসির ধার্যকৃত ব্যয়সীমা মানেন না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, বিষয়য়টি নির্বাচন কমিশন মনিটরিং করে না। এমনকি আজ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দুর্নীতিবাজেরা ভোটে কালোটাকার প্রভাব দেখান। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন যোগ্য প্রার্থীরা।

17 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন