১৩ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার

সুন্দরবন নিয়ে আমরা সত্যিই বিচলিত

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ, ১৫ মার্চ ২০১৬

বিদ্যুৎ উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদী বৃহৎ আকৃতির দুটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। প্রকল্প দুটির একটি গড়ে উঠবে রূপপুর এবং অপরটি বাগেরহাটের রামপালে। এ দুটো প্রকল্পই ভিন্ন দুটি দেশের সঙ্গে। রূপপুর আণবিক শক্তি কেন্দ্রের প্রকল্পটি এখনও চুক্তি স্বাক্ষরের পর্ব পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি; প্রাথমিক সমীক্ষা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। তবে রামপাল কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প বেশ এগিয়ে বাস্তবায়নের নিকটবর্তী হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে এ বিষয়টিতেই আলোকপাত করা হয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্ত একটি সংস্থার নাম ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কর্পোরেশন। সংক্ষেপে এনপিটিসি। এই সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা পিডিবি’র একটি স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী উভয় সংস্থা আধাআধি লভ্যাংশে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে পিডিবি’র নিকট। বাস্তবায়নাধীন এই প্লান্টে উল্লিখিত সরকারি সংস্থা দুটি ১৫ ভাগ করে ৩০ ভাগ অর্থ বিনিয়োগ করবে। বাকী টাকা এনপিটিসি সংগ্রহ করবে ভারতীয় ব্যাংক বা অন্য দাতা সংস্থার নিকট থেকে। ইতোমধ্যে পিডিবি’র অর্থায়নে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শেষ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।

সবকিছু চুড়ান্ত করার আগেই তড়িঘড়ি করে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলাস্থিত তিনটি গ্রামের জমি অধিগ্রহণ করা শুরু হয়েছে। সাপমারি, কাটাখালি ও কৈগরকাঠি মৌজার প্রায় দুই হাজার একর জমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়েছে। যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা ব্যতিরেকেই ১৩ হাজার ২শ কোটি টাকার এ প্রকল্প দেশে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে অসামান্য ভূমিকা রাখবে- তা সন্দেহাতীতভাবে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু প্রকল্পটির মন্দ দিকগুলো নীতি নির্ধারকরা কেন বিবেচনায় নিলেন না সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। ভারতের মধ্য প্রদেশে ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের উদযোগে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের তৎপরতা শুরু হয়েছিল। এ প্রকল্প সম্পর্কে সে দেশের প্রভাবশালী সংবাদপত্রসমূহে বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল। তাতে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠার সুবাদে শেষপর্যন্ত প্রকল্পটি বাতিল করতে হয়েছিল।

বাতিলের কার্যকারণ বোঝার জন্য এখানে আমরা অন্তত একটি পত্রিকার সংবাদ উদ্ধৃত করতে পারি।‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় ‘মধ্য প্রদেশে এনপিটিসি’র প্রকল্প বাতিল’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরের কিয়দংশ এরকম- জনবসতি সম্পন্ন এলাকায় কৃষি জমির ওপর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এজন্য ভারতের কেন্দ্রীয় গ্রীন প্যানেল মধ্য প্রদেশে ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কর্পোরেশনের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি। ভারতের সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি নরসিংহপুর জেলার ঝিকলি ও তুমরা গ্রামের এক হাজার একর জমির ওপর একটি ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক্সপার্ট এপ্রাইজাল কমিটির (এইসি) সভায় বলা হয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য নির্ধারিত স্থানটি মূলত কৃষি জমি প্রধান এবং এ বিষয়ে প্রকল্পের স্বপক্ষের লোকদের প্রদত্ত তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। কমিটি আরো মনে করে, মাদারওয়ালা শহরের এত কাছে এরকম একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাঙ্ক্ষিত নয়।

তাছাড়া নর্মদা নদী থেকে প্রকল্পের ৩২ কিউসেক পানি টেনে নেওয়াটাও বাস্তবসম্মত নয়; যেহেতু রাজ্য সরকার ইতোমধ্যেই আরো কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এই নদীর পানি বরাদ্দ দিয়ে বসে আছে। (‘দ্য হিন্দু’, ৮ অক্টোবর ২০১০) আমরা প্রাসঙ্গিক আরো একটি উদাহরণ এখানে উপস্থাপন করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয় প্রায় ৩০ বছর আগে। সেখানে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্রমাগত দূষণে ছাইয়ের আস্তরণে ঢেকে যাওয়ায় এবং পাশাপাশি এসিড বৃষ্টির কারণে ৪৮ কিলোমিটার জুড়ে হাজার হাজার ওক, পেকান, এলম প্রভৃতি মূল্যবান গাছে সমৃদ্ধ কয়েকটি বিশাল বাগানের ইতোমধ্যেই মৃত্যু ঘটেছে। তাহলে রামপাল প্রকল্পের মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরবর্তী সুন্দরবন পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই হারিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞগণ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, মধ্য প্রদেশে বাতিলে বাধ্য প্রকল্প বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে কেন!

কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, বিভিন্ন ক্ষুদ্র কণিকা, কার্বন মনোক্সাইড, মারকারি বা পারদ, আর্সেনিক, সীসা ও ক্যাডমিয়ামসহ পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান নিঃসৃত হয়। কয়লা পোড়ালে ছাই হয়, এর সাথে কালো ধোঁয়ার পর সৃষ্ট বর্জ্যের নাম ক্লোশ স্লাজ বা তরল কয়লা বর্জ্য। ছাই ও স্লাবি উভয়ই বিষাক্ত বর্জ্য। কারণ এর মধ্যে আর্সেনিক, মার্কারি, সোডিয়াম এমনকি তেজষ্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। তদুপরি, টারবাইন, কম্প্রেসার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার, নির্মাণ যন্ত্র ইত্যাদিও বিকট শব্দে শব্দদূষণ হবে। পার্শ্ববর্তী পশুর নদীসহ কয়েকটি নদী ও জলাশয়ের পানি দূষিত হবে বর্জ্যের কারণে। প্রকল্পে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণে পানি ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যেতে থাকবে।

সবচাইতে উদ্বেগের কারণ সুন্দরবন নিয়ে। পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যানগ্রোভ হলো সুন্দরবন। এটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ এ বনে এখনও টিকে আছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে এই নিবিড় উপকূলীয় বনাঞ্চল বিস্তৃত।এই বনভূমি থেকে দেশের ৪৫ ভাগ কাঠ ও জ্বালানী সংগৃহীত হয। সুন্দরবনের বনজ ও মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল ১০ লক্ষ দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবার। সেই হিসেবে অর্ধ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জীবন-জীবিকার জন্য নির্ভরশীল। উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালীর অধিকাংশ জেলেদের জীবিকার উৎসও এই সুন্দরবন।

দেখা যাক, উল্লিখিত প্রকল্পের দ্বারা সুন্দরবন কিভাবে ও কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রের মাধ্যমে বায়ু, পানি, কঠিন, তরল ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই প্রভূত পরিমাণে দূষণ ঘটবে। পশুর নদীসহ অন্যান্য নদীর পানিতে এর বর্জ্য মিশে নদী ও জলাশয়গুলোকে করে তুলবে দূষিত যা ক্রমান্বয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে উদ্ভিদ ও মাটির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাতে জীব বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি হবে। ফলে অনিবার্যভাবে কেন্দ্রটি সুন্দরবনের জন্য দুর্যোগের কারণ হবে বলে দেশের পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। একই সূত্র থেকে জানা গেছে, বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ ও ধুলো সৃষ্টি হবে। এতে সুন্দরবনের গাছ ও প্রাণী সম্পদ ধ্বংস হয়ে যেতে থাকবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আরো আশঙ্কা করছেন যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষাক্ত গ্যাসের কারণে সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে। জৈবিক পরিবেশ ও বায়ুমন্ডলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সালফার-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন যৌগসমূহ থেকে সৃষ্ট গ্রীন হাউস গ্যাস মারাত্মক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে সুন্দরবনের ওপর।

ইরানের রামসার শহরে ১৯৭২ সালে পরিবেশ বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে কতিপয় চুক্তি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। রামসার কনভেনশন চুক্তি বলে পরিচিত এই দলিলে বাংলাদেশ ও ভারত স্বাক্ষরদানকারী দেশ। গুরুত্ব বিবেচনায় ১৬০টি দেশের ১৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমিকে ‘রামসার এলাকা’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওড় রামসার এলাকার অন্তর্ভুক্ত। রামপালের প্রকল্প নির্মাণে রামসার কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রকল্পটি সুন্দরবনের জন্য সঙ্কটাপন্ন অবস্থা সৃষ্টি করবে বলে জানিয়েছে রামসার। সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এ প্রকল্পের ব্যাপারে উৎকন্ঠা ব্যক্ত করে তারা বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়ে অবস্থান জানতে চেয়েছে। সরকার এর উত্তর দিয়েছে কি না তা জানা যায়নি।তবে পরিবেশগত প্রতিবেদনে সুন্দরবনকে তেমন বিবেচনায় নিয়ে বলা হয়েছে, প্রকল্প থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার (বাস্তবে ৯ কিলোমিটার)।

পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানের জ্বালানী হলো কয়লা। এর ব্যবহারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অবশ্যম্ভাবী। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, সুনামী, ক্যাটরিনা, সিডর, আইলা ইত্যাদির ক্ষত শুকোতে এখনও বহু বছর সময় লাগবে। প্রকল্পের প্রভাবে এ জাতীয় দুর্যোগ আরও ত্বরান্বিত হবে বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অভিমত। গত দুই শতকে অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুন্দরবন বুক ও পিঠ দিয়ে ঠেকিয়েছে বা ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করেছে। তাই সহজেই অনুমেয়, যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে ভবিষ্যতে বনভূমিটি ত্রাণকর্তার কাজই করে যাবে। সুন্দরবন একটাই।কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের জন্য অনেক অনুর্বর, অব্যবহার্য ভূমি অন্যত্র নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

সুন্দরবনের জন্য আরেকটি হুমকি আসন্ন। সরকার সুন্দরবনের ৬ কিলোমিটার দূরবর্তী বলেশ্বর নদের তীরে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার গাবগাড়িয়া চরে দ্বিতীয় ৫২.২৪ একর জমিজুড়ে দ্বিতীয় জাহাজভাঙা ইয়ার্ড নির্মাণের তোড়জোড় শুরু করেছে। সীতাকুন্ডের পর এটি হবে দ্বিতীয় ইয়ার্ড। তিন দশক আগে প্রতিষ্ঠিত এই ইয়ার্ডের ফলে ইতোমধ্যে ১৫ কিলোমিটার উপকূলীয় বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ পড়েছে হুমকির মুখে। বলেশ্বর প্রকল্পের ব্যাপারে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় আপত্তি জানালেও তা উপেক্ষিত হয়ে ইয়ার্ড নির্মাণের প্রাথমিক কাজ এগিয়ে চলেছে। এই দুটো প্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে।

সুন্দরবন রক্ষায় কেন্দ্রীয়ভাবে বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে ১০১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাপবিদ্যুৎ ও জাহাজভাঙা প্রকল্প যৌথভাবে সুন্দরবনের জন্য যথেষ্ট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে- এ ব্যাপারে পরিবেশবাদী ও অন্যন্য মহল নিশ্চিত। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল, প্রাণ-প্রকৃতির আধার এবং পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ আমাদের রাষ্ট্রীয় গর্ব সুন্দরবন সুরক্ষায় আমরা এগিয়ে আসবো নাকি উটকো প্রকল্পের মাধ্যমে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেব তা নিয়ে জনসাধারণ সত্যিই বিচলিত। কিন্তু না, সরকার বিস্ময়করভাবে নির্বিকার।

আইয়ুব হোসেন : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট ।

23 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন