২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

অন্তর্দ্বন্দ্বে পুড়ছে বরিশাল বিএনপি: সমাবেশে লোকসমাগম নিয়ে টেনশন!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:৩০ অপরাহ্ণ, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

অন্তদ্বন্দ্বে পুড়ছে বরিশাল বিএনপি: সমাবেশে লোকসমাগম নিয়ে টেনশন!

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল:: সরোয়ারবিহীন বরিশাল বিএনপির শক্তি যেন ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ এবং সু-সংগঠিত থেকে রাজপথে শক্তপোক্ত ভুমিকা রাখলেও এখানে বিরোধী দল বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে যেন গতি পাচ্ছে না। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং মাঠের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার লাভে একে অপরকে কোণঠাসা করতে গিয়ে বরিশাল বিএনপিতে তৈরি হয়েছে একাধিক উপদল। বিশেষ করে বরিশাল সদর আসনের ৫ বারের এমপি ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমানকে কাবু করতে গিয়ে এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ৪ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরের জিলা স্কুল মাঠে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে উল্লেখসংখ্যক কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতির ভাবনা শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে টেনশনে ফেলে দিয়েছে। এনিয়ে ভেতরে ভেতরে নেতৃত্ব এবং ডাকসাইডের নেতাদের মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। তাছাড়া গত ৫ নভেম্বর একই শহরে সমাবেশ করার তিন মাসের মাথায় আবারও অনুরুপ কর্মচসূচি পালনের উদ্যোগকে তৃণমূলের বড় একটি অংশ ইতিবাচক হিসেবে নিতে পারেনি। সঙ্গত কারণে আগামীকালের সমাবেশে কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতি উল্লেখ্যযোগ্য হওয়ার সম্ভবনা কম বলে অনুমান করা হচ্ছে। যদিও সমাবেশ সফল করার দায়িত্বে থাকা নেতারা বলছে- এবারের সমাবেশে লোকসমাগম ঘটিয়ে কাউকে কিছু দেখানোর নেই। তারপরেও জিলা স্কুল মাঠে লোকজনের নজিরবিহীন উপস্থিতি দেখা যাবে।

তবে শীর্ষ সারির নেতাদের এমন বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারছে না তৃণমূলের বড় অংশটি। তাদের দাবি, ৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু উদ্যানে সমাবেশে অংশ নিতে গিয়ে শত শত নেতা-কর্মী সরকারদলীয় লোকজনের হামলায় আহত এবং একাধিক মামলায় জর্জড়িত হয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে মাত্র তিন মাসের মাথায় আবারও বিএনপি অনুরুপ একটি কর্মসূচি পালন করতে গেলেও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উৎসহ বা সমাবেশে অংশগ্রহণের আগ্রহ লক্ষ্যণীয় নয়।

অবশ্য এর কারণ হিসেবে অংশটি দলের নীতি-নির্ধারকদের দুষছেন। আবার কারও কারও কাছ থেকে মন্তব্য এসেছে- কয়েক নেতার আধিপত্য বিস্তার এবং নেতা সরোয়ারকে কৌশলে কোণঠাসা করতে গিয়ে বরিশাল বিএনপিকে ক্রমশই  সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল করে ফেলেছে। ফলে এনিয়েও বিএনপির হাইকমান্ডের ওপর নাখোশ একটি অংশ। এক্ষেত্রে অনেকের মন্তব্য হচ্ছে- সরোয়ারবিহীন বরিশাল বিএনপি পথ হারিয়েছে, আন্দোলন-সংগ্রামে পাচ্ছে না গতি।

অভিযোগ এসেছে, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক এবং সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ এক সময়ের রাজনৈতিক গুরু সরোয়ারের ছত্রছায়া থেকে সরে আসা এবং তাঁর বিরোধীতা করে স্থানীয় রাজনীতিতে নিজেদের বলয় তৈরি ও শক্তি সঞ্চার করতে গিয়ে টালমাটাল নেতৃত্ব গড়ে তুলেছেন। ফলে সরোয়ার সমর্থিত বিএনপির বিশাল একটি অংশ কেন্দ্রঘোষিত আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ভিন্ন মোড়কে মাঠে থাকলেও রাজনৈতিক ঢামাঢোল আর আগের মত বাজছে না, বরংঞ্চ দায়সাড়া ভাবে পালিত হচ্ছে কর্মসূচি।

বলা বাহুল্য যে, এমন লেজেগোবরে পরিস্থিতির মধ্যে এই এখানকার নেতৃত্বে বিভাজন নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক উপদল। এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা এবায়দুল হক চাঁনও হাঁটছেন নিজস্ব আঙ্গিকে। তিনি কারও সাথে যুক্ত না থেকে কর্মী-সমর্থক নিয়ে কর্মসূচি পালন করছেন। সরোয়ার অনুসারীদের অবস্থানও অনুরুপ। নবগঠিত কমিটি বরিশাল জেলা (দক্ষিণ) বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন এবং সদস্যসচিব (সাবেক এমপি) আবুল হোসেন কর্মী-সমর্থক নিয়ে মাঠে থাকলেও মহানগরের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে তাদের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে, ৪ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি নিয়ে তাঁরা বিপরিত মেরুতে অবস্থান নিয়ে আছেন এবং নিজেদের আঙ্গিকে রাজপথে শক্তপোক্ত ভুমিকা রাখতে চাইছেন। নেতাদের এই বিভাজন এবং নিজস্ব বলয় সৃষ্টির অন্তর্কোন্দলে তৃণমূলে ভর করেছে ঘোর অন্ধকার, হতাশ কর্মী-সমর্থকেরা।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে ডাকসারির একাধিক নেতা জানান, এক সময়কার রাজনৈতিক গুরু সরোয়ারকে কোণঠাসা করতে গিয়ে বরিশাল বিএনপির নেতৃত্বকে দুর্বল করে ফেলেছে। এই বিষয়টি অনুধাবন করে তৃণমূল এখন কেন্দ্রঘোষিত আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করলেও পূর্বের ন্যায় উজ্জীবিত হতে পারছে না। তাই এবারের সমাবেশেও কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতির হার নিয়ে ঘোর টেনশন তৈরি করেছে দলের অভ্যন্তরে।

স্থানীয় বিএনপির এমন করুণ অবস্থার কথা স্বীকার করে একাধিক নেতা বলেন, শুধু নেতা সরোয়ারকে কোণঠাসা করে রাখা নয়, মনিরুজ্জামান-জাহিদ নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি-বলয় সঞ্চার করতে গিয়ে মহানগর বিএনপিকে একটি বেসামাল নেতৃত্বে রুপ দিয়েছেন। অবশ্য এই দৈন্যতার জন্য সরোয়ারের নেতিবাচক ভুমিকাও রয়েছে। তাকে মহানগরের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর তিনি স্থানীয় রাজনৈতিতে আধিপত্য বিস্তার এবং প্রভাব রাখতে একেক সময় একেক নেতাকে সমর্থন দেওয়ায় তৈরি হয় গ্রুপিং। যে কারণে মহানগর ও জেলার নেতারা সরোয়ারবিহীন যে যার মত করে সামনে অগ্রসর হওয়ায় গ্রুপিং আরও জোরালো রুপ নেয়। যদিও শেষত্বক শোনা যাচ্ছে- বরিশাল জেলা বা মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে এখন আর সরোয়ার হস্তক্ষেপ করছেন না। বরং তিনি অনুসারী-অনুগতদের নিয়ে ভিন্ন মেরুতে আছেন।

দলের কেন্দ্রীয় একটি সূত্র নিশ্চিত করে, নেতা সরোয়ারের এমন মানসিকতার বিষয়টি হাইকমান্ড পর্যবেক্ষণ পরবর্তী তাকে গত ৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু উদ্যানে আয়োজিত সমাবেশে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পন করেনি। অবশ্য সেসময় তাকে বিশেষ কোনো ভুমিকায়ও দেখা যায়নি। সেই সমাবেশে সরোয়ার অংশ নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিকদের কাছে তেমন একটা মূল্যায়িত হননি। এনিয়ে পরবর্তীসময়ে বরিশাল বিএনপির ভেতর থেকে নানা কথা শোনা গেলেও সরোয়ার প্রাসঙ্গিক বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

বরিশাল বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অতীতের নোংরা রাজনীতি এড়িয়ে সরোয়ার এবার মনস্তাত্ত্বিক ভাবে চাইছেন দ্বন্দ্ব-বিবাদ ভুলে ৪ ফেব্রুয়ারির সমাবেশকে কেন্দ্র করে কর্মী-সমর্থকদের চাঙা করে তুলতে। ফলশ্রুতিতে বিগত সময় অপেক্ষা তিনি অনুসারীদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন এবং জেলা ও মহানগরের নেতাদের সাথেও সমন্বয় করছেন। ৫ নভেম্বরের সমাবেশে অতিথিদের তালিকায় প্রতাপশালী এই নেতার নাম না থাকলেও তাঁকে এবার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামীকালের সমাবেশে সরোয়ারকে বিশেষ অতিথির চেয়ারে দেখা যাবে। আর এ সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান।

একাধিক নেতা জানান, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সরোয়ারের দলে গুরুত্ব অনুধাবন করে তাঁকে এবার বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এতে তিনি খুশি হয়েছেন, সমাবেশকে জনসমুদ্রে রুপ দিতে কয়েকদিন ধরে কাজ করছেন। কিন্তু তারপরেও কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতি নিয়ে আয়োজকরা বেশ টেনশনে আছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

যদিও মহানগর বিএনপি’র সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ নিজেদের মধ্যকার বিরোধ নেই উল্লেখ করে বলেন, স্থানীয় নেতৃত্বে কোনো বিরোধ নেই। তবে যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল তার অবসান ঘটেছে, সমাবেশকে ঘিরে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।

এর আগে জাহিদ মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ১০ দফার স্বপক্ষের এই সমাবেশ কর্মসূচিতে পুরো বিভাগের ৬ জেলা থেকে নেতাকর্মীরা অংশ নেবে। সেক্ষেত্রে উপস্থিতি সংখ্যাগত দিক থেকে লক্ষাধিক হবে। তবে একটি বিভাগীয় শহরের তিন মাসের ব্যবধানে দুটি বড় সমাবেশ কেন এমন প্রশ্নে নেতৃত্ব সারির নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে- বিএনপি মার্চ মাসে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবে, তখন আর ১০ দফা নয়, দাবি থাকবে একটি সরকার পতন। সেই আন্দোলনকে বেগবান করতে এবং নেতাকর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত রাখতে তিন মাসের মাথায় এই সমাবেশ করা হচ্ছে।

বিভাগীয় শহরের এই সমাবেশকে সফল করতে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) অ্যাডভোকেট বিলকিছ জাহান শিরিন বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সেচ্ছাচারিতায় দেশের জনগণ ওষ্ঠাগত। এই ফ্যাসিস্ট সরকারের কবল থেকে জনতা এখন মুক্তি চায়, কিন্তু তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে একের পর এক অপকৌশল নিচ্ছে। র‌্যাব-পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করে আন্দোলতরত বিএনপি নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে হয়রানির ওপর রাখছে। মাঠে নামলে হামলা-মামলা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সংবাদপত্রসহ সাধারণ মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। দেশের মানুষ আওয়ামী শাসনতন্ত্র থেকে পরিত্রাণ পেতে বিএনপির সাথে আছে এবং সরকারবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে মাঠে নামছে।

এক্ষেত্রে নেতা সরোয়ারের অভিন্ন মন্তব্য হচ্ছে- বরিশাল বিএনপিতে কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই, যা ছিল তা ভুল বোঝাবুঝি। সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি প্রশ্নে সকলে এক এবং তাদের নেতা দলের ভারপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিক-নির্দেশনায় কাজ করছেন। এবং আগামীকাল শনিবারের সমাবেশ নেতাকর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণে মহাসমাবেশে রুপ নেবে মন্তব্য করেন আপদামস্তক এই নেতা।’

 

 

1 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন