২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

আহমেদ মুন্না’র কলাম: দুই প্রজন্মের শিক্ষাগুরু একজন শাহজাহান মানিক

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৩:৩১ পূর্বাহ্ণ, ১৬ মে ২০১৯

আহমেদ মুন্না’র কলাম:

“দুই প্রজন্মের শিক্ষাগুরু একজন শাহজাহান মানিক”

 

কিংবদন্তিতুল্য মানুষটার নাম শাহজাহান মানিক। মূল পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন ক্রীড়া সংগঠক। আদ্যোপান্ত একজন আলোকিত সাদা মনের মানুষ হিসেবে সর্বমহলে যার পরিচিতি। তিনি সবার প্রিয় মানিক স্যার। প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। টানা দুই প্রজন্মের একজন বরেণ্য শিক্ষক তিনি। একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।
 
তিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বাবুগঞ্জ পাইলট হাইস্কুলে (বর্তমানে সরকারি বাবুগঞ্জ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়) আমার বাবার শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে বাবুগঞ্জ হাইস্কুলেই তারা একসঙ্গে শিক্ষকতাও করেছিলেন। তাই বাবার সাথে তার খুবই মধুর সম্পর্ক ছিল। পরে ১৯৭১ সালে সেই শিক্ষক-ছাত্র মিলে একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। তিনি নিজের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি মিলিটারিরা সেই খবর জানার পরে তার বাড়িসহ কেদারপুর ইউনিয়নের বেশ কিছু বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালিয়ে অনেক বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল।
 
দেশ স্বাধীনের পরে তিনি আবার ফিরে যান তার পুরানো পেশায়। মনোনিবেশ করেন শিক্ষকতায়। খানপুরা গ্রামের তৎকালীন বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও রহমতপুর ইউপি চেয়ারম্যান মরহুম মোতাহার আলী হাওলাদার তাদের পৈত্রিক জমিতে একটি স্কুল তৈরি করেছিলেন। টিনের ছাপড়া দিয়ে শুরু হওয়া সেই ‘খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ নামের স্কুলটিতে পরবর্তীকালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাঠদান ও যাবতীয় উন্নয়ন কার্যক্রমের দায়িত্ব পড়ে শাহজাহান মানিকের ওপর। তিনি তখন নামমাত্র বেতনে সেই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধে নেমে পড়েন। একপর্যায়ে মেট্রিকুলেশন (SSC) পরীক্ষার সেন্টারও নিয়ে আসেন সেই জীর্ণ স্কুলে। টিনের ছাপড়ায় তৈরি সেই খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি সুরম্য ভবনে আজ অত্যাধুনিক রাশেদ খান মেনন মডেল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরের নেপথ্যে যাদের অসামান্য অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে শাহজাহান মানিক অন্যতম।
 
১৯৯৩ সালে খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (বর্তমানে রাশেদ খান মেনন মডেল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়) তাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাই আমি। হেডমাস্টার হলেও তিনি কখনো বাংলা কখনো ইংরেজি ক্লাস নিতেন। তিনি ক্লাস নিতে আসলে ছুটির ঘন্টা বাজলেও হুঁশ থাকতো না তার। তিনি পড়াতেই থাকতেন। পাঠদানের সময় তিনি কড়া মেজাজে থাকতেন বলে কেউ তাকে ছুটির ঘন্টা বাজার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার সাহস পেত না। একদিন দশম শ্রেণিতে টেস্ট পরীক্ষার আগে তিনি শেষ প্রিয়ডে ইংরেজি ক্লাস নিতে এসেছিলেন। ৪৫ মিনিট ক্লাসের পরে ৪টায় যথারীতি স্কুলে ছুটির ঘন্টা বেজে যায়। সবাই একেএকে স্কুল থেকে চলে যায় শুধু দশম শ্রেণি ছাড়া। এভাবে ৫টা বেজে যায়। আমাদের সবার চোখেমুখে তীব্র অস্বস্তি আর বিরক্তিভাব থাকলেও কেউ সাহস করে বলতে পারিনি-স্যার ৫টা কিন্তু বাজে। তবে শেষ পর্যন্ত এসে কথাটা সাহস করে বলেছিল আমাদের স্কুলের দপ্তরি। অবশ্য কড়ামেজাজি হেডস্যারের সামনে দুঃসাহসটা সে করেছিল নিতান্তই বাধ্য হয়ে। কারণ, হেডমাস্টার ক্লাস নেওয়ার কারণেই ছুটি হওয়ার একঘন্টা পরেও সে স্কুল তালা মেরে বাড়িতে যেতে পারছিল না।
 
এভাবেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতেন দুই প্রজন্মের শিক্ষাগুরু শাহজাহান মানিক। কোনো লোভ কিংবা মোহে নয়, নিতান্তই আন্তরিকতা থেকে তার সবসময় প্রচেষ্টা ছিল তার ছাত্রছাত্রীরা ভালো ফলাফল করুক। শুধু লেখাপড়াতেই নয়, খেলাধুলার প্রতিও তার আন্তরিকতার অভাব ছিল না। তিনি নিজে খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করতেন। এছাড়াও ভলিবল এবং কাবাডি খেলা ছিল তার প্রিয় খেলা। বাবুগঞ্জ উপজেলার ক্রীড়াঙ্গনে তার অবদান অসামান্য। এ কারণে তিনি উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার আহবায়ক নির্বাচিত হন। বহুবছর সেই দায়িত্ব পালন করছেন এবং এখনো এই বার্ধক্যকালেও সেই দায়িত্ব তিনি সফলতার সাথে পালন করে যাচ্ছেন।
 
খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে তিনি নিজের গ্রামের বাড়ি কেদারপুর সোনার বাংলা হাইস্কুল ও কলেজের দায়িত্ব নেন। অধ্যক্ষ হিসেবে শেষ কর্মজীবন কাটান তিনি সোনার বাংলা হাইস্কুল ও কলেজেই। সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখা এ মানুষটি নিজের জন্মভূমিতে একটি সোনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা করে গেছেন তার শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। প্রায় ৫০ বছরের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরগ্রহণের পরেও তিনি বিভিন্ন ক্রীড়া, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। দীর্ঘদিন উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতা এবং বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের বাবুগঞ্জ উপজেলার আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
 
দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের শিক্ষকতা জীবনে শাহজাহান মানিকের হাতে গড়া অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি আমলা, সরকারি-বেসরকারি বড় বড় কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন একসময়ে মানিক স্যারের পাঠদান করা শিক্ষার্থীরা। কেউ তাকে মনে রেখেছে কেউবা রাখেনি। তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই, নেই কোনো অনুযোগও। বরং এটা তার সীমাহীন গর্ব যে, তার অনেক ছাত্র আজ দেশের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত। এতটুকুই তার শিক্ষকতা জীবনের আত্মতৃপ্তি। ব্যক্তিজীবনে শাহজাহান মানিক দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তার শ্বশুর পাকিস্তান পার্লামেন্টের (ন্যাশনাল এসেম্বলি) হিজলা-মুলাদী আসন থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য (MNA) ছিলেন।
 
বর্তমানে ডায়াবেটিস এবং স্ট্রোক ছাড়াও বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বাঁধলেও অনন্তযৌবনা এ মানুষটির মনোবল কাবু করতে পারেনি। কেবলমাত্র মনের জোরেই চিরতরুণ এ মানুষটি লাঠিতে ভর দিয়ে এখনো ছুটে আসেন উপজেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সেদিন তার সঙ্গে দেখা হয় উপজেলা সম্মেলন কক্ষে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) বাস্তবায়ন বিষয়ক একটি সরকারি কর্মশালায়। চিরায়ত স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে লাঠিতে ভর দিতে দিতে তার জন্য নির্ধারিত আসন ছেড়ে আস্তে এসে বসেন আমার পাশের চেয়ারে। আমি বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের সদস্য সচিব আর তিনি আহবায়ক হওয়ার কারণে হয়তো নয়। হয়তোবা ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্কের কারণেও নয়। সেদিন তার চোখেমুখে থাকা আকুলতায়, মায়াভরা চাহনিতে কিছুটা নিঃসঙ্গতায় ছিল ভিন্ন কিছু। তার নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেদিন কোনো কড়ামেজাজি শিক্ষাগুরুকে নয়, বরং এক পরম স্নেহাতুর পিতাকেই দেখেছিলাম!
 
শতায়ু হোন হে শিক্ষাগুরু পিতা। সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন কমপক্ষে শতবছর কিংবা তারও বেশি। একদিন নিশ্চয়ই কেউ একজন আপনার কর্মমুখর বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে ইতিহাস লিখবে আর সেদিন আপনি হবেন এই শতাব্দীর একজন কিংবদন্তি..!!
 
লেখক: আরিফ আহমেদ মুন্না
কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন