১০ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

ঈদ-পরবর্তী ছুটিতে পর্যটকদের বরণে প্রস্তুত কুয়াকাটা

বরিশালটাইমস, ডেস্ক

প্রকাশিত: ০২:৪১ অপরাহ্ণ, ০৮ এপ্রিল ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: ঈদ-পরবর্তী লম্বা সরকারি ছুটিতে পর্যটকদের বরণ করে নিতে প্রস্তুত সাগরকন্যা খ্যাত পটুয়াখালীর পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সারছেন হোটেল-মোটেল থেকে শুরু করে সব শ্রেণির ব্যবসায়ীরা। কুয়াকাটার নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

রমজান মাস কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ছিল সুনসান নীরবতা। এবার ঈদের টানা ছুটিতে সেই নীরবতা ভাঙার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কুয়াকাটার শতাধিক আবাসিক প্রতিষ্ঠানে রঙ করা ও ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় প্রচুর সংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

কুয়াকাটার বিভিন্ন পয়েন্টে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আবাসিক হোটেল-মোটেলগুলো সেজেছে বাহারি সাজে। অনেক হোটেলের আসবাবে এসেছে নতুনত্বের ছাপ। অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন রঙের ছোঁয়ায় সাজাচ্ছেন তাদের মনের মতো করে। দোকানিরাও তাদের পসরা সাজাতে পার করছেন ব্যস্ত সময়। দোকানে স্থান পাচ্ছে নানাবিধ নতুন নতুন বাহারিপণ্য। সৈকতের ছাতা-বেঞ্চেও লেগেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। ঈদে টানা ছুটিতে পর্যটকরা ভ্রমণে আসবেন বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যটক সংশ্লিষ্টরা পর্যটকদের বরণ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। পর্যটন স্পট, হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউসগুলো বুকিং দিতে শুরু করেছেন দর্শনার্থীরা।

কেন যাবেন কুয়াকাটা

সাগরকণ্যা কুয়াকাটা ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকের কাছে অনন্য নাম। বাংলাদেশের ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সৈকতে দেখা মেলে নৈসর্গিক সৌন্দর্য। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।

কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থানসমূহ

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা এখন পর্যটন নগরী হিসাবে সমস্ত বিশ্বে পরিচিত। এর পাশাপাশি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি তীর্থস্থান। রাস মেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষ্ণভক্তরা হাজির হয় পুণ্য স্নানের জন্য। এ সময় দেশি-বিদেশি লাখ লাখ পূণ্যার্থীরা আসেন পুণ্যস্নান করতে।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত : কুয়াকাটার মূল আকর্ষণ দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সমুদ্র সৈকত। সমুদ্র সৈকতে দাঁড়ালে দক্ষিণে যতদূর চোখ যায় ততদূর নীলাকাশ। বেলাভূমিতে প্রতিমুহূর্তে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। সমুদ্র সৈকতে হাজার হাজার পর্যটকদের জন্য বেসরকারিভাবে বসার জায়গা, ঘোড়া, গাড়ি, খাবারসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। সমুদ্রসৈকতের ভাঙন ঠেকানোর জন্য বনবিভাগের মনোলোভা ঝাউবন রয়েছে। যেখানে বাতাসের শো-শো শব্দ আপনাকে বিমোহিত করবেই।

কুয়াকাটার কুয়া : কুয়াকাটা নামকরণ যে কুয়া থেকে এসেছে। সমুদ্রের লবণ পানির এলাকায় মিষ্টি পানির একমাত্র আধার এই কুয়া। কুয়াকাটার বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশের মুখে কুয়াটির অবস্থান। বর্তমানে সরকারের আর্থিক সহায়তায় কুয়াটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার : কুয়ার পাশের রয়েছে বৌদ্ধমন্দির। যা শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার নামে পরিচিত। এখানে নয়টি ধাতুর সমন্বয়ে তৈরি বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। এ ছাড়া বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশের মুখে দাঁড়ানো দুইটি মূর্তি রয়েছে। এগুলো চুনদ্রী দেবীর। রাখাইনদের ধর্মীয় বিশ্বাসে চুনদ্রী দেবী মন্দিরের রক্ষাকর্তা। উপরের দিকে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে রয়েছে শাক্য রাজার মূর্তি। বিহারটি সাধারণ জনসাধারণের জন্য সকাল ৮টা থেকে ১১টা ও ২টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দর্শনার্থীদের জন্য জনপ্রতি টিকিট ১০ টাকা।

কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান (ইকোপার্ক) : কুয়াকাটা জিরোপার্ক থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্ব দিকে ৭০০ একর জায়গাজুড়ে কুয়াকাটা ইকোপার্ক অবস্থিত। এখানে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ধরনের বনজ-ফলজ গাছ লাগানো হয়েছে। সৈকত ঘেঁষা এ বনভূমি আপনাকে আকর্ষণ করবে।

কেরানি পাড়া : কুয়াকাটার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত রাখাইন পল্লীর নাম কেরানি পাড়া। এখানে গেলে আপনি রাখাইনদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পারবেন। অবশ্য ব্রিটিশ আমলে নলাউ নামক একজন রাখাইন ব্যাংকের কেরানি পদে চাকরি করতেন। তার পদবীর থেকে এই পল্লীর নাম হয় কেরানি পাড়া।

মিশ্রিপাড়া সীমা বৌদ্ধ বিহার : কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে সাত কিলোমিটার পূর্ব দিকে মিশ্রিপাড়ায় রাখাইন পল্লী অবস্থিত। এখানকার বৌদ্ধমন্দির যা সীমা বৌদ্ধ বিহার নামে পরিচিত। এখানে দুইশো বছরের পুরাতন বৌদ্ধমূর্তি ও ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে। জানা যায় প্রভাবশালী মিশ্রি তালুকদারের নামে এ পল্লীটির নামকরণ করা হয়।

আলীপুর ও মহিপুর মৎস্য বন্দর : বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মৎস্য বন্দর এটি। এখানে সারা বছর সমুদ্রের সব ধরনের মাছ পাওয়া যায়।

ইলিশ পার্ক অ্যান্ড রিসোর্ট : কুয়াকাটা পৌরসভা এলাকায় ইলিশ পার্কের অবস্থান। জিরো পয়েন্ট থেকে পাঁচ মিনিট সময় লাগে। ৪০ শতাংশ জমির উপর এ পার্কটি অবস্থিত। পার্কের ভেতরে বিভিন্ন প্রাণির ভাস্কর্য রয়েছে। রয়েছে ইলিশের অবয়বে একটি হোটেল।

শুটকি পল্লী: পটুয়াখালী জেলায় শুটকির চাহিদা না থাকলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে শুটকির চাহিদা থাকায় সমুদ্র তীরবর্তী কুয়াকাটায় শুটকি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে এই পল্লীর অবস্থান পরিবর্তন হলেও বর্তমানে সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে লেম্বুর চরে অস্থায়ীভাবে বাঁশ দিয়ে শুটকির মাচা তৈরি করে শুটকি উৎপাদন চলছে। অল্প দামে কিনতে পারেন বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুটকি।

গঙ্গামতির চর: কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে ৬ কিলোমিটার পূর্ব দিকে গঙ্গামতির চরের অবস্থান। গঙ্গামতি খালের চরে গড়ে উঠায় চর গঙ্গামতি বা গঙ্গামতির চর বলা হয়। সৈকতের পূর্ব দিকে হওয়ায় এখান থেকে ভোরের সূর্যোদয় স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

লেম্বুর বন: সাধারণত পর্যটকরা লেম্বুর বন বা বাগান মনে করলেও আসলে লেম্বু ছিল রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি মেয়ে। এখানে তার বাড়ি ও বাগান ছিল। কালের পরিক্রমায় সে বাড়ি সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে। এখান থেকে পশ্চিম দিকে তাকালে নদীর ওপারে ফাতরার বন দেখা যায়। আবার এই লেম্বু বন সৈকতের সর্ব পশ্চিমে হওয়ায় এখান থেকে সূর্যাস্ত সবথেকে ভালো দেখা যায়। এখানে সামুদ্রিক শামুক ঝিনুকের প্রচুর খোলস পাওয়া যায়। এখানে বেশ কিছু কাঁকড়া বা মাছ ফ্রাইয়ের দোকান গড়ে উঠেছে।

ফাতরার বন: আন্ধারমানিক নদীর মোহনা পার হয়ে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে এ ম্যানগ্রোভ বনের নামই ফাতরার বন। এ বনের মধ্যে হরিণ, বানর, শুকর, বন মোরগ, শিয়াল, বাঘডাস, মেছোবাঘ, ভোঁদড়, খরগোশ, অজগর দেখতে পাওয়া যায়।

সোনার চর: পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলায় সোনার চর অবস্থিত। বঙ্গোপসাগরের বুকের এ চরটি দক্ষি সীমার শেষ ভূখণ্ড। এখানেও বিভিন্ন ধরনের পশু পাখি রয়েছে।

পানি জাদুঘর: মানুষকে পানি সম্পদ ব্যবহারে সচেতন করার জন্য এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এশিয়ার প্রথম পানি জাদুঘর। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলা থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে কুয়াকাটা যেতেই পাখিমারা বাজারে পাশে অবস্থিত। একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে।

চর বিজয়: চারদিকে অথই জলরাশি, আর শুধু ধু-ধু বালু। বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা এক অনন্য ভুবন ‘চর বিজয়’। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেনা-অচেনা পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে এ চরে। বালিয়াড়িতে অগণিত লাল কাঁকড়া নৃত্য। এ যেন ভিন্ন নয়নাভিরাম নীল দিগন্তবিস্তৃত অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি। গঙ্গামতী সৈকত থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে প্রায় ২৫ কিলোমিটার গভীরে এ দ্বীপটির অবস্থান। বিজয়ের মাসে সন্ধান পাওয়ায় এর নামকরণ করা হয়েছে চর বিজয়। তবে কুয়াকাটায় আগত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা।

সর্বোপরি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক মোহময় লীলাভূমির নাম কুয়াকাটা। এখানে আসলে এর মোহময় আকর্ষণ পর্যটককে বিমোহিত করবেই। ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে আগত পর্যটকদের জন্য সৈকত মার্কেটের ব্যবসায়ী আলামিন নতুন পুরনো পন্যে সাজাচ্ছেন তার দোকান।

এদিকে সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলার জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আনোয়ারুল আজিম বলেন, এরই মধ্যে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। আসবাবপত্রে নতুনত্ব আনা হয়েছে। এখন অবধি আমাদের প্রতিষ্ঠানের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রুম বুকিং হয়েছে। এ বছর আগের বছরগুলোর তুলনায় পর্যটকদের সাড়া কম পাচ্ছি। তবে আশা করছি ঈদ পরবর্তী লম্বা ছুটিতে ভালো সংখ্যক পর্যটক কুয়াকাটায় ঘুরতে আসবেন।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখের ছুটিকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার পর্যটক কুয়াকাটায় আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কুয়াকাটার সব শ্রেণির ব্যবসায়ীরা তাদের প্রস্তুতি এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছেন।

কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর মো. ফয়েজ জানান, ইতোমধ্যে সমুদ্র সৈকতসহ গুরুত্বপূর্ণ বিনোদকেন্দ্রগুলোতে টুরিস্ট পুলিশের তৎপরতা শুরু হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলোতে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। পর্যটকদের হয়রানিসহ বাড়তি ভাড়া, বাসি খাবার, অতিরিক্ত খাবারের দাম বন্ধের জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ সৈকতে পোশাকধারীর পাশাপাশি সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করবে।

86 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন