২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

থানায় বোমা মারতে ওসিকে নির্দেশ দিলেন আ’লীগের এমপি শাহীন চাকলাদার (!)

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৪:০১ অপরাহ্ণ, ৩০ জানুয়ারি ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: যশোরের কেশবপুর থানায় বোমা মেরে এক আইনজীবীকে ফাঁসাতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশনা দিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ শাহীন চাকলাদার। জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের এমন একটি অডিও ক্লিপ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে এই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ হাইকমান্ডে নানান প্রশ্নে জন্ম দিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রথম আলো পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবাদন প্রকাশ করলে এই বিতর্ক আরও জোরালো রুপ নেয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কেশবপুরের একটি ইটভাটার বিষয়ে অভিযোগ দাখিল করায় সাইফুল্লাহ নামে ওই আইনজীবীকে শায়েস্তা করতে এ নির্দশনা দেন যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার। একই সঙ্গে যে কোনো ইট ভাটায় সিভিল পোশাকের পুলিশ দিয়ে বোমা হামলা চালিয়ে ডাকাতির অভিযোগে আইনজীবী সাইফুল্লাহকে মামলার আসামি করারও দৈব-দাওয়ায় বাতলে দেন তিনি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সাংসদের যে অডিও ক্লিপ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে রীতিমত উচ্চআদালতের নির্দেশনাকেও উপেক্ষা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রমাণ মিলেছে।

অনলাইন ‘বরিশালটাইমস’র পাঠকদের জন্য অডিও ক্লিপের আলাপচারিতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে…

ওসি: স্লামালাইকুম স্যার।
শাহীন চাকলাদার: ঘুম?
ওসি: না স্যার। ঘুমাইনি স্যার।
শাহীন চাকলাদার: সাতবাড়িয়ার সাইফুল্লাহ কিডা?
ওসি: সাতবাড়িয়া… সাইফুল্লাহ আছে, স্যার ওই ইটভাটার একটা বিষয় নিয়ে সাইফুল্লাহ, ‘বেলা’য় (বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি) যেয়ে মামলা-টামলা করে আর কী। বাজে একটা ছেলে স্যার।
শাহীন চাকলাদার: সাইফুল্লাহ… আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে। না অইলে কোন জায়গায় করবেন? আমি যা বলছি, লাস্ট কথা ইডাই। যদি পারেন ওই এলাকা ঠান্ডা রাখতি, আমি বন ও পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। ওখানে কারও বাপের ক্ষমতা নেই। বারবার যেয়ে কেন করে, আপনি কী করেন?
ওসি: ও তো স্যার হাইকোর্টের কাগজ নিয়া আসে বারবার।
শাহীন চাকলাদার: আরেহ… কোথার হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট। কোর্ট-ফোর্ট যা বলুক, বলুইগ্যা। অন্য… আমাদের খেলা নাই? খেলা নাই?
ওসি: হাইকোর্টে স্যার…
শাহীন চাকলাদার: ওসি হলি, ওসি কিন্তু ডায়নামিক হইতে অয়। আজকে বাগারপাড়া ওসি আসছিল আমার কাছে। ওরে আবার চৌগাছায় দিয়ে দিচ্ছি। ও ওসি..চেনেন? বাগারপাড়া ওসিকে চেনেন?
ওসি: চিনি না স্যার? মামুন সাহেবরে?
শাহীন চাকলাদার: কথা বইলেন তার সাথে। তাকে নিয়ে আসতেছি চৌগাছায়। আপনে ওকে যে কোনোভাবে, যে কোনো লোক দিয়ে, কাইলকে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়ে কালকে কাজটা করেন, ওকে।
ওসি: স্যার, দেখি স্যার। কী হয়েছে স্যার? ওর কি ডিস্টার্ব করতেছে আবার?
শাহীন চাকলাদার: ও কী ডিস্টার্ব করবে? আচ্ছা, বন ও পরিবেশ অফিসে আমি আছি। কার বাপের ক্ষমতা আছে এখানে আসবে! আমি বলছি কী, একটা আপনি খেলা খেলে ওকে ভেতরে নিয়ে আসেন। কথা বুঝেন নাই?
ওসি: স্যার, স্যার। দেখবোনে স্যার।
শাহীন চাকলাদার: কেমন অফিসার আপনি, আল্লাই জানে। কাজ দিলি কাজ পারেন না।
ওসি: হা হা হা হা স্যার। সব কাজই তো করি, স্যার।
শাহীন চাকলাদার: সব কাজ করেন, না? তালিপরে যে কোনো ভাটায় যেয়ে, দরকার হলি পুলিশের দিয়ে লোক দিয়ে সিভিলে বোম ফাটায় দিয়ে চলে আসুক। বলতে হবি যে হামলা করেছে ডাকাতি করার জন্য। এটা ছিল অমুক। একটা বানাই দিলে অয়া গেল।
ওসি: ও স্যার, ওই যে, ওই যে, বেলার যে কাগজটা আসছে, ওডা দেখছেন স্যার আপনে? হাইকোর্টের কাগজটা।
শাহীন চাকলাদার: বেলা-ফেলা আমি দেখবোনে, আমি তো স্থায়ী কমিটির সদস্য।
ওসি: হাইকোর্টের কাগজটা স্যার। হাইকোর্ট।
শাহীন চাকলাদার: হাইকোর্টের কাগজে কী বলেছে?
ওসি: রিসেন্টলি, গতকাল একটা কাগজ আসছে হাইকোর্টের থেকে স্যার।
শাহীন চাকলাদার: কী আছে?
ওসি: আমি দেখাবনে স্যার কালকে। কালকে সকালে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দেবোনে আপনারে, স্যার। হাইকোর্ট থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা আসছে ওই যে, সুপার ব্রিকস বন্ধ রাখার নির্দেশ দিসে স্যার।
শাহীন চাকলাদার: আমাদের এলাকায় স্কুল-কলেজ বাদে আমি আমার এলাকায় কোনো ব্রিকস বন্ধ করব না। যে যেই দিগ্যা। আমি করব না।
ওসি: কাগজটা তো দেখবেন, স্যার। কী লিখছে, স্যার।
শাহীন চাকলাদার: ঠিক আছে, ওকে।
ওসি: আচ্ছা দেখবানে স্যার।

আইনজীবী সাইফুল্লাহ বলেন, কেশবপুর উপজেলার উত্তর সাতবাড়িয়া গ্রামের মেসার্স সুপার ব্রিকস নামের ইটভাটাটি আমার বাড়ির পাশে। পরিবেশদূষণ হচ্ছে বলে আমি গ্রামবাসীকে সংঘটিত করে আন্দোলন শুরু করি। পরবর্তীতে এ আন্দোলনের খবর স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকাতে প্রকাশ হয়। পত্রিকার সংবাদ দেখে বেলা নামে একটি এনজিও জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করে। এরপর বেলা কর্তৃপক্ষ আমাকে নেটওয়ার্ক মেম্বার নির্বাচিত করে এবং আমি তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে যোগ দেই।

তিনি আরও বলেন, গত ১২ ডিসেম্বর কেশবপুর থানার ওসি আমাকে থানায় ডাকেন। এরপর বলেন, আপনি যে ভাটার বিপক্ষে কাজ করতেছেন এটা তো এমপি মহোদয় চান না। তো আপনি ওখান থেকে সরে আসেন। নইলে আপনার ক্ষতি হয়ে যাবে। তো আমি বললাম, স্যার আমি তো ভাটার পেছনে নই। আসলে আমি ওই বেলার নেটওয়ার্কিং মেম্বার হওয়াতে এগুলো কাজ করতে হয়। পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হয়। তখন ওসি স্যার আমাকে বলছেন, আগে তো আপনার নিজের জীবন, আপনি এগুলোর মধ্যে জড়াচ্ছেন কেন? আপনি ওখান থেকে সরে আসেন, তা না হলে কিন্তু চাকলাদার সাহেব আমারে দিয়ে হোক বা অন্য থানার ওসি দিয়ে হোক আপনাকে ফাঁসায় দেবে।

আইনজীবী সাইফুল্লাহ বলেন, আমি থানাতে ছিলাম। রাত ১০টার দিকে আমি রেজোয়ানা আপাকে, বেলার প্রধান, স্থানীয় সাংবাদিকদের ফোন করে বিষয়টি জানাই। আপা বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করলে ওসি সাহেব আমাকে রাতে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। এই পর্যন্তই আমি জানি। এখন অডিও ক্লিপের কথা শোনা যাচ্ছে। তবে সেটি আমি নিজে শুনিনি। আপনার কাছে কি অডিওটা আছে?

কথোপকথনের বিষয়ে জানতে চাইলে কেশবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসিম উদ্দিন বলেন, আমার স্মরণে নেই। কেন বারবার একই প্রশ্ন করেছন। আমি এমপি সাহেবের সঙ্গে প্রতিদিনই কথা বলি। কত কথাই তো হয়। সব কথা তো ওইভাবে স্মরণে থাকে না।

এদিকে যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংবাদমাধ্যমটিকে তিনি বলেন, এ ধরনের কথাবার্তা ওসির সঙ্গে তার হয়নি। এটা কেউ টেম্পারিং করে বানিয়েছে।
শাহীদ চাকলাদার বলেন, আমি যে এলাকার সাংসদ, সেটা জামায়াত–অধ্যুষিত। এখানে কেউ এটা বানিয়েছে। এ ধরনের কোনো কথা হয়নি। ওসিও আমাকে বলেছেন, এ ধরনের কোনো কথা হয়নি।

সংসদ সদস্য ও সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুর পর ১৪ জুলাই যশোর-৬ আসনে উপনির্বাচন হয়। এই উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার।’

25 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন