২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক ‘মানবতার বাজার’

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:০২ অপরাহ্ণ, ১৭ এপ্রিল ২০২০

নাজমুল হক তপন:: করোনায় আক্রান্তের সর্বশেষ আপডেট,  মৃত্যুর সংবাদ, ত্রাণ,  ত্রাণের চাল – তেল চুরি, করোনাক্রান্তদের সেবা করতে গিয়ে সম্মুখসারির যোদ্ধা চিকিৎসকদের মৃত্যু, খুব সাভাবিক কারণে এগুলোই এসময়ের প্রধান খবর। এর মাঝে বরিশাল জেলা বাসদের (বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল) উদ্যোগে ‘মানবতার বাজার’ সংবাদটা গত কয়েকদিন ধরে ছোট করে হলেও জায়গা পেয়েছে মিডিয়াতে। প্রতিদিন কমপক্ষে দুশ অসহায় পরিবারকে বিনামূল্যে নিত্য প্রযোজনীয় দ্রব্য সাহায্য করছে বরিশাল বাসদ। এর আগে এই একই সংগঠনের উদ্যোগে দশটি ইজিবাইককে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করে চালু করা হয় গরীব মানুষদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম।

এগুলো সবই পুরনো খবর। যতদূর জানি, ‘মানবতার বাজার’ কার্যক্রম শুরু হয়েছে পাঁচ দিন আগে। ধরেই নিয়েছিলাম, এই উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া ফেলবে, ছড়িয়ে পড়বে দেশব্যাপী। সরকার তো বটেই, বড় বড় রাজনৈতিক দল, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষত এনজিও, বিভিন্ন  সামাজিক সংগঠন তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবেও এই ধরনের কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়বেন অনেকে।

বাংলাদেশের আট বিভাগের ৬৪ জেলাধীন উপজেলার সংখ্যা ৪৯২। মোট পাঁচশ জায়গায় এমন একটা করে ‘মানবতার বাজার’ কর্মসূচি নেয়া কি খুব কঠিন?  প্রতিটা জেলায় যদি এই ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে এর ঢেউ যে উপজেলাগুলোতে পড়বে তা বলাইবাহুল্য। আর উপজেলাগুলোতে এই ধরনের কর্মসূচি নিলে তার প্রভাব ইউনিয়ন এমনকি গ্রামগুলোতেও পড়তে বাধ্য। ইতিবাচক উদ্যোগে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সাড়া দেয়নি এমনটা খুব কমই ঘটেছে।

আমরা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধ সময়ের উদাহরণ দিই। এটা যৌক্তিক কারণেই। কেননা আমাদের আত্মপরিচয়ের মূল মানদণ্ড মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু একটা বিষয় আমরা এড়িয়ে যাই। একাত্তরে আমাদের সামর্থ্য (আত্মিক-মানসিক নয় আর্থিক) কী ছিল আর কতটুকুই বা ছিল? অথচ ওই সময় দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন এদেশের মানুষ।  বৈশ্বিক  দৃষ্টিকোণ থেকে করোনাকালকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। আমরা তো এই করোনাক্রান্তিকে আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে দেখতেই পারি! কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা বহু মত-পথে বিভক্ত। এটাও খুব বড় সমস্যা না। ‘গাছে-মাছে প্যাঁচ খাইছে’, এমন একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে গ্রাম দেশে। প্রবল বন্যার সময় মাছও আশ্রয় খোঁজে গাছে। এই প্রবাদটার  অর্থ, চরম বিপদের সময় কারো আলাদা থাকার সুযোগ নেই। সবাই এক হয়ে যায়, দাঁড়ায় এক কাতারে। কিন্তু এই ক্রান্তিকালেও আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি বিভেদের চোরাবালিতেই। ব্যক্তিগত লোভ-লাভালাভের সঙ্কীর্ণ গলি – ঘুপচির মধ্যেই আটকে ফেলেছি নিজেদের।

স্বাধীন দেশ পা রেখেছে পঞ্চাশে। অর্ধশতাব্দীর গর্ব কোথায় আমাদের! একাত্তরে আমাদের কয়টা দালানকোঠা ছিল, কয়জনের গাড়ি ছিল, কতজন কোটিপতি ছিল? প্রশ্নটাই অবান্তর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাইকেল কেনার সঙ্গতি ছিল না এমন মানুষ দামি গাড়ি হাঁকাচ্ছেন। এক প্রজন্মেই গ্রামের মেঠোপথ থেকে অনেকেই  পৌঁছে গেছেন ফাইভ স্টারে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকাতার আশীর্বাদে অনেকের কাছেই শত কোটি টাকা তো বটেই হাজার কোটি টাকাও নস্যি! সহজ কথায় দেশটা স্বাধীন হয়েছিল বলেই না এত সব ঠাঁট-বাট। আর এই দেশেই সামান্য কয়েক দিনের লকডাউনে খাবারের জন্য লাইন ধরতে হয় মানুষকে! অভুক্ত মানুষ ত্রাণ ছিনিয়ে নিয়েছে এবং এর জন্য মামলাও হয়েছে, এমন সংবাদও এসেছে মিডিয়াতে। যে হারে ত্রাণের চাল চুরির সংবাদ আসছে তার তুলনায় নিরন্ন মানুষকে অনেক সহনশীল বলতেই হবে! ত্রাণের চাল-তেল চুরি বন্ধ না হলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আাঁচ করুন!

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হই না। তবে এ সপ্তায় রোগী দেখতে কয়েকবার ল্যাবএইডে যেতে হয়েছে। আমার বাসা থেকে ৩০/৩২ মিনিটের হাঁটা পথ। মেইন রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দ্বিতীয় দিন খেয়াল করলাম লেদার টেকনোলোজির সামনে বেশ কিছু সাহায্যপ্রার্থীর ভিড়। এর কাছাকাছিই হাজারীবাগ থানা থেকে ছোট বক্সে খাবার নিচ্ছে কেউ কেউ। আজ দেখলাম হাজারীবাগ থানা ও লেদার টেকনোলোজির সামনে বেজায় ভিড়। রীতিমত জটলা। যেহেতু মননে – মগজে পুরো মধ্যবিত্ত তাই লেদার টেকনোলিজর সামনের রাস্তা দিয়ে অনেক মানুষের মাঝ দিয়ে হেঁটে আসার সময় ভয়ও পেলাম। মনে রাখতে হবে, স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদশের ভিক্ষুক কিন্তু পার্সেন্টেজে পড়ে না। যাদেরকে দেখলাম তারা যে খেটে খাওয়া মানুষ, বুঝতে পারলাম চেহারা দেখেই। দেশে করোনাক্রান্তর সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই  কাজ না পাওয়া, খাবারের কষ্টে থাকা মানুষের সংখ্যা যে বাড়বে সেটা অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার।

আপনাদের ফাইভ স্টারে খাওয়া আর প্লেনে ঘুমানোর মূলে যে মেহনতি মানুষের শ্রম-ঘাম, অন্তত একবারের জন্যও এটা ভাবুন। কিছুমাত্র চাওয়া-পাওয়ার হিসাব না কষেই, আপনাদের জীবন বাঁচিয়ে রেখেছে কৃষক আর জীবন সাজানোর কাজটি করে যাচ্ছে শ্রমিক-মজুর। স্বাধীন দেশ আপনাদের দিয়েছে দুহাত ধরে। সেই দায় অনুভব করার এখনই সময়।

‘মানবতার বাজার ’ সামনে হাজির করে কয়েকজন তরুণ তুর্কী প্রমাণ করে ছেড়েছে যে মানুষের প্রতি মমতা থাকলে, সদিচ্ছা থাকলে সীমিত সামর্থ্য নিয়েও অনেক বড় কাজ করা সম্ভব। এই ক্রান্তিকালে আশা করছি, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ ‘মানবতার বাজার’ স্বপ্নের বীজটি শাখায়-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে শোভিত হয়ে উঠবে ফুলে-ফলে, ছড়িয়ে পড়বে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।

7 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন